মো নো য়া র হো সে ন : অনামিকার মনে আজ খুব আনন্দ। দাদু তার জন্য চশমা কিনে এনেছে। লাল ফ্রেমের সুন্দর চশমা। সেই চশমা চোখে দিয়ে একবার সে আম্মুর কাছে যাচ্ছে তো আর একবার দাদুর কাছে। ফিক করে হেসে বলছে, দাদু দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে। অনামিকার এমন কা- দেখে দাদুর হাসি তো একেবারে কানে গিয়ে ঠেকেছে। খকখক করে হেসে বলেন, লালপরীর মতো লাগছে দিদিভাই।
আনন্দ আরো বেড়ে যায় অনামিকার।
দু’মাস হলো কিন্ডার গার্টেন স্কুলে নার্সারীতে ভর্তি হয়েছে সে। স্কুলের ঈশিতা মেম লাল শাড়ি, লাল টিপ, আর লাল ফ্রেমের চশমা পরে স্কুলে আসেন। তাকে দেখে মনে হয় আস্ত একটা লালপরী। ঈশিতা মেমকে খুব ভালো লাগে অনামিকার। ঈশিতা মেম যখন ক্লাসে আসেন তখন তার দিকে টিপটিপ চোখে তাকিয়ে থাকে সে। ভাবে, ইশ! আমি যদি ঈশিতা মেমের মতো হতাম! আমারও যদি একটা লাল চশমা থাকত, আমাকেও দেখতে নিশ্চয় লালপরীর মতো লাগত।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে সেদিন বিকেলে দাদুকে বলল, আচ্ছা দাদু, লাল চশমা কোথায় পাওয়া যায়? লাল চশমার কি অনেক দাম?
দাদু বললেন, কেনো রে?
না দাদু, এমনি বললাম।
দাদু বুঝতে পারেন দিদিভাই নিশ্চয় কোথাও লাল চশমা দেখেছে। তার লাল চশমা খুব পছন্দ হয়েছে। তাই বিকেলে বাজারে গিয়ে তার জন্য সুন্দর দেখে একটা লাল ফ্রেমের চশমা কিনে নিয়ে আসলেন। লাল চশমা দেখে অনামিকার সে কী আনন্দ! হেসে কুটি কুটি যায় একেবারে। দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে। চোখে চশমা পরে এঘর ওঘর দৌড়ে বেড়ায়।
দাদু এখন লালপরী বলাতে তার আনন্দ আরো বেড়ে গেল। চোখে চশমা দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বাসার সবাইকে তার চশমা দেখাতে লাগল। ভাইয়ার রুমে গিয়ে মনে পড়ল, ভাইয়া নেই। চাকরির জন্য বাইরে আছে। তার সুন্দর চশমাটা ভাইয়াকে দেখাতে পারল না বলে তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। চোখের পাতা ভিজে আসল। কিছুক্ষণ মন খারাপ করে ভাইয়ার রুমে চুপচাপ বসে থাকল সে। তারপর গিয়ে আম্মুর ফোন থেকে ভাইয়াকে কল দিল। মন খারাপ করা গলায় বলল, ভাইয়া!
ওপাশে ফোন রিসিপ করে আন্দলিব বলল, হ্যাঁ খুকি বল।
আমার মনটা খুব খারাপ।
কেন ?
দাদু আমাকে একটা লাল চশমা কিনে দিয়েছে। সেই চশমা তোমাকে দেখাতে পারলাম না বলে মন খুব খারাপ।
হেসে উঠল আন্দালিব। আরে বোকা, দাদু তোকে চশমা কিনে দিয়েছে এ তো মহা আনন্দের খবর। এতে মন খারাপের কি আছে? তুই আম্মুর ফোন থেকে আমাকে একটা ভিডিও কল দে, দেখি তোর চশমাটা।
ঠিকই তো ভিডিও কল দিয়ে ভাইয়াকে তো সে চশমাটা দেখাতে পারে। এই সহজ বুদ্ধিটা এতক্ষণ তার মাথায় এলো না কেন? খামাখা এতক্ষণ মন খারাপ করে কেনো বসে থাকলাম আমি? ভাবে অনামিকা। ভেবে নিজে নিজে লজ্জা পায় ও। তাড়াতাড়ি ভাইয়াকে ভিডিও কল দিল সে। নাক বরাবর চশমায় আঙ্গুল চেপে ধরে চোখ টানটান করে বলল, ভাইয়া!
হ্যাঁ খুকি।
দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?
একেবারে কালিদাশের প-িত মশাই!
ভাইয়া! ঢং করো না তো, ঠিক করে বলো।
চশমাটা খুব সুন্দর খুকি। চোখে দিয়ে তোকে খুব সুন্দর লাগছে। যেন লালপরী।
সত্যি?
হুম সত্যি।
হি-হি-হি করে হেসে উঠল অনামিকা। তার মন খারাপ একেবারে ভাল হয়ে গেল।
তারপর থেকে প্রায় চোখে চশমা পরে নাক বরাবর আঙ্গুল চেপে ধরে টানটান চোখ করে ভাইয়াকে ভিডিও কল দেয় সে। চশমা দেখায়। লালপরী কথা শুনে তারপর থামে।
একদিন স্কুল থেকে এসে দেখল দাদু ভীষণ অসুস্থ। বিছানায় শুয়ে আছে। দাদুকে অসুস্থ দেখে তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে স্কুল ব্যাগটা টেবিলে রেখে বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সে ঠিক করল তার প্রিয় লাল চশমাটা বিক্রি করে দাদুকে ভাল ডাক্তার দেখাবে।
পরের দিন স্কুল যাওয়ার সময় চুপিচুপি চশমাটা বের করে বইয়ের ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে নিল সে। স্কুলের গেটে ঢুকার মুখে সামনে একটা বিশাল বড় চশমার দোকান আছে, সেখানে চশমাটা বিক্রি করে দেবে সে। প্রিয় চশমা বিক্রি করতে গিয়ে তার খুব কান্না পাচ্ছে। বুকটা হাঁপরের মতো উঠানামা করছে। কান্নায় হেঁচকি কাটচ্ছে। তবুও দাদুকে তো ভালো করতে হবে।
চশমার দোকানে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে একবার ভালো করে দেখে নিল সে। তারপর আস্তে করে স্কুলব্যাগ থেকে চশমাটা বের করে দোকানদারকে বলল, ভাইয়া, এই চশমাটা নিবেন?
খুব সুন্দর চশমা তো, তুমি বিক্রি করবে কেন?
দাদু খুব অসুস্থ। দাদুকে ডাক্তার দেখাতে হবে। অনেক টাকা দরকার। তাই.....
হুম। দাম কত?
আপনি বলেন কত দিবেন?
এই চশমার তো অনেক দাম। তোমার দাদুকে ডাক্তার দেখাতে যত টাকা লাগে। কিন্তু আমার কাছে এখন যে অত টাকা নেই।
স্কুল ছুটির পর নিয়ে যাব।
না, তোমাকে কালকে টাকা দেব আমি।
আচ্ছা। মাথা ডানে সুন্দর করে দুলিয়ে বলল অনামিকা।
ফোনে আন্দালিবকে সব বলল রাসেল।
চশমার দোকানদার রাসেল আন্দালিবের বন্ধু।
সব শুনে ছুটি নিয়ে বাসায় এল আন্দালিব। দেখল অনামিকা পড়ার টেবিলে বসে হাতদুটো টেবিলের উপর টানটান করে ছিটিয়ে রেখে দুইহাতের মাঝখানে মাথা ঢুকিয়ে মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছে। পেছন থেকে আন্দালিব এসে তার চোখে লাল চশমাটা পরিয়ে দিল।
হতভম্ব হয়ে গেল অনামিকা। ভাইয়া!
আর কোনো কথা নয়, চল দাদুকে নিয়ে আমাদের এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে রাস্তায় দাদু আর মাকে সব খুলে বলল আন্দালিব। সব শুনে দাদুর চোখের কোণ জলে ভরে উঠল। গৌরবে বুক ভরে গেল। অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে বললেন, দিদিভাই, তোমার ভালোবাসা পেয়ে সত্যিই আজ আমি সুস্থ হয়ে গেছি রে। আমাকে আর কোনো ডাক্তার দেখাতে হবে না। দাদুর কথা শুনে মা আর আন্দালিবের চোখ থেকেও দু’ফোঁটা আনন্দঅশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
মন্তব্য করুন