এমাজউদ্দীন আহমদ : ইতিহাসের কোনো কোনো অধ্যায় গৌরবমন্ডিত হয়ে রূপান্তরিত হয় মহান ঐতিহ্যে। তখন তা ইতিহাসের অন্ধ গলি অতিক্রম করে হয় গতিশীল আর জাতীয় জীবনের দুকূল ছাপিয়ে হয়ে ওঠে বিশ্বাস এবং আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। সঙ্কটকালে জাতি সেদিকে তাকায় সাহসের জন্যে, শক্তির জন্যে, বিশ্বাসের জন্যে। সাথে সাথে কৃতজ্ঞতার ডালা সাজিয়ে নিজেদের সে মহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পৃক্ত করে নতুনভাবে আত্মপ্রত্যয় লাভ করে। ভাষা আন্দোলন এ জাতির তেমনি এক ঐতিহ্য আর একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনিভাবে এ জাতির শক্তি, সাহস ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণে শহীদ মিনার এ জাতির এক তীর্থক্ষেত্র।
জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির মূলে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি মনের বিদ্রোহ প্রকাশিত হল। এ আন্দোলনে জনগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনা সূচিত হল। কালক্রমে এ চেতনার ভিত্তিতে এ অঞ্চলের জনসমষ্টি এক অপ্রতিরোধ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উজ্জীবিত হল। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মনের ইস্পাতকঠিন শপথ চতুর্দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত। এ আন্দোলনেই সর্বপ্রথম বাঙালি যুবকরা রক্তদানের তাৎপর্য অনুধাবন করে। আর দাবি আদায়ের যে পরম আনন্দ তা প্রাণভরে উপভোগ করে। এ আন্দোলনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্ব।
অতীত সম্পর্কে গৌরববোধ, বর্তমান উপভোগ বা বঞ্চনা আর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করে এবং জনমনে গড়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ সুরের মূর্ছনা। জাতীয়তাবাদের মূলে ধর্ম-ভূখ-, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য বা অতীত স্মৃতি কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। তাই নিয়ে বিভিন্ন লেখক ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহিৃত করলেও এর মৌল সূত্র যে সমষ্টিগত চেতনা এ বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই। ভাষা আন্দোলন এ ভূখ-ের জনসমষ্টির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করে, আপামর জনসাধারণের মধ্যে সামগ্রিক এক সত্তার প্রত্যয়, সমষ্টিগত এক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদের সুপ্ত সূত্রগুলোকে প্রাণবন্ত করে তোলে। ফলে পূর্ব বাংলার জনসমষ্টির মধ্যে সৃষ্টি হল নতুন জীবনবোধ, নতুন আত্মসচেতনতা, বাঙালি পরিচয়ে নতুন গর্ববোধ। সর্বপ্রকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আদর্শিক এক দৃঢ় প্রত্যয়।
কোনো জনসমষ্টির মহত্তর সৃষ্টি তার ভাষা। ভাষা একদিকে যেমন কোনো জাতির প্রতিভা বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম অন্যদিকে তেমনি সে জাতির প্রতিভারও শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন। ভাষা কিন্তু সংগোপনে তৈরিও হয় না। তা নির্দিষ্ট কোনো জাতি বা ভূখ-ে সীমিতও থাকে না। একটি ভাষা বহু জাতি ব্যবহার করতে পারে। আমাদের ভাষা, ভারতের একাংশে প্রচলিত। বাংলাদেশে যা জাতীয় ভাষা ভারতে তা আঞ্চলিক ভাষা। আমাদের কাছে যা মায়ের ভাষা, আমাদের প্রতিবেশীর নিকট তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও একটি আঞ্চলিক ভাষা। অনেক ক’টির একটি। ফলে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলায় যে সাহিত্য রচিত হল তার প্রকৃতি হল ভিন্ন। একটিতে অনুরণিত হল জাতীয় সত্তার অন্তরঙ্গ সুর কিন্তু অন্যটিতে শুধু প্রতিফলিত আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য।
সাহিত্য হিসেবে শ্রেষ্ঠতর হয়েও পশ্চিম বাংলায় সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের বীজ উপ্ত হল না। উভয় বাংলায় ভাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সৃষ্টিধর্মী নির্মাণ প্রক্রিয়ায় চুন-সুরকির পরিমাণ সম্ভবত একই ছিল কিন্তু বাংলাদেশের মনমানসিকতায় যে ঐক্যানুভূতি ছিল, তাই জন্ম দেন এক অনন্য স্থাপত্যের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মহান সৌধের। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা ডিজাইনবিহীন অতি সুন্দর দেয়ালের বেশি কিছু সৃষ্টি করেনি। দু’বাংলার ভাষা ও সাহিত্যে যে পার্থক্য তার সুস্পষ্ট প্রকাশ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে। তাই কালে বেগবতী ¯্রােতস্বিনীরূপে সর্বস্তর ছাপিয়ে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের এবং আরো পরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতিসত্তার ভিত্তিতে রূপান্তরিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য সৌকর্যে তেমন কোনো সম্ভাবনার সৃষ্টি করেনি। ফলে পশ্চিমবঙ্গ তার উন্নত সাহিত্য সম্ভার নিয়েও ভারতীয় সভ্যতার ¯্রােতধারায় বিলীন হল। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েও বেছে নিলো আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ। হাজারো ধারায় রক্ত ঝরিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদের সিঁড়ি বেয়ে ছিনিয়ে আনল স্বাধীনতার লাল গোলাপ। এদিক থেকে বলা যায়, ভাষা আন্দোলন একদিকে এ জাতির মহত্তর স্থাপত্য অন্যদিকে তেমনি এ জাতিসত্তার প্রধানতম স্থপতিও।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন