আলম শামস : বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। বাঙালি জাতির প্রাণের ভাষা। এ ভাষার সাথে মিশে আছে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার ও জাতীয়তা বোধ। বাঙালির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব চিন্তা-চেতনা ও মননে মিশে আছে বাংলা ভাষা। এ ভাষার ইতিহাস বাঙালি জাতির অস্তিত্বের ইতিহাস।
১৯০ বছর শাসনের পর ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বৃটিশমুক্ত হয়। জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। পাকিস্তান আবার ২ অংশে বিভিক্ত। পূর্ব পাকিস্তান, আর পশ্চিম পাকিস্তান। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি এবং আমাদের রাষ্ট্রভাষা উর্দু। আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ প্রতিটি বাঙালির চেতনায় ও মননে উপলব্ধি করার নিমিত্তে ১৯৪৭-এর ১ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন হয়। এই সংগঠনটিই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রথম উত্থাপন করে এবং ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করে। তমদ্দুন কর্তৃক তিন প্রাজ্ঞজনের লেখাসমৃদ্ধ একটি পুস্তিকা প্রকাশের পর থেকে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মনের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রশ্নটি ধূমায়িত হয়ে ওঠে। কিন্তু সদ্যপ্রসূত নতুন রাষ্ট্রের নাজুক শৈশবের কথা বিবেচনা করে ভাষা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা বা সাহস অনেকের ছিল না।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঢাকায় ছাত্রসমাজ, ছাত্রীসমাজ ও জনগোষ্ঠী দফায় দফায় আলোচনা সভা ও বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হন। যেসব গণ্যমান্য নারীগণ তখন তমদ্দুন মজলিশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন তাদের অন্যতম ছিলেন আনোয়ারা খাতুন। তিনি ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং বায়ান্নর সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য। ভাষা আন্দোলনে নারীদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন গাইবান্ধার বেগম দৌলতুন্নেসা। তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন।
নাদেরা বেগম ও লিলি খান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন। হামিদা খাতুন, নূরজাহান খুরশিদ, আবাসারী খানম, রানু মুখার্জি প্রমুখ মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকার বাইরে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলে সেখানেও স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা পোস্টার, বান্যার লিখতে সাহায্য করেন। ধর্মঘট উপলক্ষে প্রচুর পোস্টার লেখার দায়িত্ব পালন করেন ডক্টর সাফিয়া খাতুন ও নাদিয়া চৌধুরী। একুশে ফেব্রæয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে যে মহিলারা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় সৃষ্টি করেছিলেন তারা হচ্ছেনÑ সাফিয়া খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, সামসুন নাহার, আহাসান নাদেরা চৌধুরী, রওশন আরা বাচ্চু, কাজী আমিনা, সারা তৈবুর প্রমুখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।
একুশে ফেব্রæয়ারির নৃশংসতার প্রতিবাদে অভয়দাস লেনের এক সভায় নেতৃত্ব দেন বেগম সুফিয়া কামাল, নূরজাহান খুরশিদ। বেগম দৌলতুন্নেসার নেতৃত্বে ছাত্রীদের একটি প্রতিবাদ মিছিল হয়। ২৮ ফেব্রæয়ারিতে মিছিলে গুলি চালানোর প্রতিবাদে নুরজাহান খুরশিদ ও লায়লা সামাদের নেতৃত্বে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনে শরিক হন বেগম সুফিয়া কামাল, লুলু বিলকিস বানু। নারায়ণগঞ্জের মর্গান হাইস্কুলের হেড মিসট্রেস মমতাজ বেগম স্থানীয়ভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সিলেটের মেয়েরাও ১৯৪৮ থেকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তারা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের নিকট মহিলা প্রতিনিধি পাঠান। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের সভানেত্রী জোবেদা খাতুন চৌধুরানী। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সাহারা বানু, সৈয়দা লুৎফুন নেসা, রাবেয়া বেগম। ১৯৪৭ সালে আজাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে একটা লেখা প্রকাশিত হলে যশোরের হামিদা সেলিম রহমান নামে এক নারী একটা নিবন্ধ লেখেন। পরে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম সম্পাদিকা হয়েছিলেন। তার সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করেছিলেন সুফিয়া খাতুন, হাসিনা খাতুন নামে দু’জন মহিলা। চট্টগ্রামের বেশকিছু ছাত্রী ও গণ্যমান্য কিছু মহিলাও এ সময় সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করেন। তারা হচ্ছেন তোহফাতুননেসা আজিম, সৈয়দা হালিমা সুলতানা বেগম, নুরন নাহার জহুর, আনোয়ারা মাহফুজ, আইনুননাহার। খুলনাতে কাজ করেন তমদ্দুন মজলিশের কর্মী আনোয়ারা বেগম, সাজেদা আলী এবং আরো অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রী। সাতক্ষীরাতে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন গুণ আরা বেগম ও সুলতানা চৌধুরী। টাঙ্গাইলে আন্দোলনের সঙ্গে সমৃদ্ধ ছিলেন নুরুন্নাহার বেলী, রওশন আরা শরীফ, নাজমা আরা শরীফ প্রমুখ।
রংপুরেও এ সময় মহিলারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ও মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন নিলুফার আহমদ, বেগম মালেকা আশরাফ, আফতাবুন্নেসা প্রমুখ। এসব নারীর মধ্যে বেশিরভাগ স্কুল-কলেজের ছাত্রী। ভাষা আন্দোলনে নানা দলের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অনেক মহিলাও ছিলেন। ১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের ছাত্রীরাও ভাষা শহীদদের মিছিলে শরিক হয়েছিলাম। ভাষা আন্দোলনের সেই উত্থান দিনগুলোর কথা মনে হলে প্রথমে মনে আসে
তিনজন ইতিহাসে উপেক্ষিত নারীর মুখ। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ১৯নং আজিমপুরের অন্দর মহলে উপেক্ষিত ছিল এই তিন নারীর কর্মশালা। কোনোরূপ মিটিং-মিছিল-বক্তৃতায় অংশগ্রহণ না করেও এই তিন নারী সে সময় বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ অনেক তরুণের প্রেরণার উৎস ছিলেন। এই তিনজন মহিলার নাম রাহেলা খাতুন, রহিমা খাতুন ও রোকেয়া বেগম। রাহেলা খাতুন ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেমের স্ত্রী। রহিমা খাতুন কাসেম সাহেবের বোন। রোকেয়া বেগম তার সম্বন্ধীর স্ত্রী। স্বামীর আদর্শের কাছে নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে রাহেলা খাতুন মোমবাতির মতো জ্বলেছেন, পুড়েছেন আর আগরবাতির মতো সুবাস ছড়িয়েছেন আদর্শবাদী একঝাঁক তরুণের মনে। রোকেয়া বেগম প্রতিবেলা বিশ-ত্রিশজন লোকের রান্নার কাজে রাহেলা খাতুনকে সাহায্য করতেন হাসিমুখে। রহিমা খাতুনও তাদের সহায়ক কর্মী হিসেবে সব ধরনের কাজে সাহায্য করতেন। রাত ২টার আগে ঘুমাতে যেতে পারতেন না এই তিন নারী। তারপরও গুঞ্জন, কথাবার্তা, হট্টগোলে ঘুমানো কষ্টকর হয়ে পড়ত। এমন কষ্টকর পরিস্থিতিতে এই তিন নারী আন্দোলনের মূল উৎসকে বেগবান রাখতে সাহায্য করেছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশ যখন উত্তপ্ত, পুলিশের ধরপাকড় চলছে নানাদিকে। বায়ান্নর ২৩ ফেব্রæয়ারির গভীর রাতে কাসেম সাহেবও সৈনিক পত্রিকা সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুরকে গ্রেফতার করার জন্য ১৯নং আজিমপুরে পুলিশ এসে হাজির। রাহেলা খাতুন অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে পুলিশের পথ রুদ্ধ করে রাখেন অনেকক্ষণ। ইতোমধ্যে অধ্যাপক কাসেম সাহেবও আবদুল গফুর পেছনের দরজা দিয়ে সরে পড়েন। পুলিশ ঘরে ঢুকে তাদের না পেয়ে ফিরে যায়। মমতাজ এবং আধ্যাপক আবদুল গফুরের ছাত্রী নিলুফার সাতচল্লিশে মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রী। অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেবের সঙ্গে পূর্ব পরিচিতির সুযোগে এই বাসায় মাঝে মাঝেই যেতাম। পোস্টার লেখা ও স্কুলের দেয়ালে সেঁটে দেয়ার দায়িত্ব পালনের পালা তখন থেকেই শুরু হয় আমাদের। তমদ্দুন মজলিশের ছত্রছায়ায় ভাষা আন্দোলন-সংগ্রাম জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পল্লবিত হয়েছে। হাজার সালাম জানাই তমদ্দুন মজলিসের সেই সময়ের অগ্রজ
প্রতিম ভাইদের। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অনেক লেখক মজলিশের সাপ্তাহিক সৈনিকে লিখে বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন। নারী লেখক, সাহিত্যিক তৈরির ক্ষেত্রেও তমদ্দুন মজলিশের ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অনেক গুরুত্ববহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন