স্টালিন সরকার : ‘এসব দেখি কানার হাট-বাজার/ পন্ডিত কানা অহঙ্কারে/সাধু কানা অন্-বিচারে/মোড়ল কানা চুগলখোরে---’। জীবনমুখী এই বাউল গান বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজের পরতে পরতে বিদ্যমান। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আনা বাংলাদেশ এখন হয়ে গেছে কানার হাট-বাজার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সমতা, মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়-নিশ্চিতের কেউ নেই। সত্য-মিথ্যা, নীতি-নৈতিকতা, ভালো-মন্দ, বিচার-বিবেচনা যেন উঠে যাচ্ছে। মন্ত্রী সরকারি বাসায় আন্দোলন ঠেকানোর বৈঠক করার কথা; পক্ষান্তরে তিনি আন্দোলনের বৈঠক করে কর্মসূচি দেন। ধর্মঘটের নামে রাজপথে হয় তান্ডবলীলা। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কর্মে সরকার বিব্রত, অথচ নীরব। রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ মিডিয়া দিনকানার মতো দলদাসের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় গোটা দেশ কার্যত কানার হাট-বাজারে পরিণত করেছে।
দেশ পরিচালনার জন্য মন্ত্রী হন; সেই মন্ত্রী পরিবহন ধর্মঘট করে উল্টো দেশ অচল করে দেন। আবার সেই মন্ত্রী আদালতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ধর্মঘটিদের সাফাই গেয়ে বুক ফুলিয়ে দাবি করেন- ধর্মঘট নয়; সেচ্ছা কর্মবিরতি। নৌ-মন্ত্রীর ভাষায় ‘চালকেরা সেচ্ছায় গাড়ি চালানো থেকে বিরত আছেন’। আবার তিনিই অন্য সহকর্মী মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দিলে ঘুরতে শুরু করে গাড়ির চাকা। মন্ত্রীত্ব হলো প্রশাসনের দায়িত্ব পালন। শ্রমিকরা অবরোধ-ধর্মঘট করলে মন্ত্রীর কাজ জনমানুষের সুবিধার্থে শ্রমিকদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করা। অথচ মন্ত্রী নিজেই ‘সর্প হইয়া দংশন করে/ ওঝা হইয়া ঝাড়ে’ ভ‚মিকায় অবতীর্ণ। বিরোধীদের ঠেঙ্গাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খুই করিৎকর্মা। হেফাজতের কয়েক লাখ নিরীহ আলেমকে এক ঘণ্টায় মতিঝিলের শাপলাচত্বর থেকে ছদ্রভঙ্গ করা যায়। অথচ সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের নৈরাজ্য বন্ধে ৩৩ ঘণ্টা সময় লাগে। মন্ত্রী বলে কথা! মন্ত্রীই অবরোধ করেন; তিনিই অবরোধ তুলে নেন। আমরা জনগণ চোখ থাকতেও দেখি না; কান থাকতেও শুনি না। তারা যা বলেন ‘তারে নারে না’ সেটাই বিশ্বাস করি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী সবাই যেন ‘কানার হাট-বাজারে’ নিজেদের শামিল করেছি। কেউ দল কানা, কেউ সুবিধা কানা, কেউ বা রেখেছেন বিবেক বন্ধক। প্রকৃত চিত্র দেখতে আমরা যেন ভুলে গেছি। এ অবস্থায় ঘুমন্ত কানা ঘোড়ার গায়ে চাবুক মারার মতোই ঘা দিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২ মার্চ বিএনপি আহূত ‘অবস্থান প্রতিবাদ কর্মসূচি’তে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সিপিবি-বাসদ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে পারলে আমরা কেন পারব না!’ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সিপিবি-বাসদের হরতাল কর্মসূচি পালন করছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র ও পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করতে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। দিল্লিকে খুশি রাখতে এটা খুবই প্রয়োজন। সুন্দরবন বিধ্বংসী এই প্রকল্পের প্রতিবাদে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সঙ্গে দুই-তিনবছর ধরে রাজপথে রয়েছে বামদলগুলো। এ সব আন্দোলনে সরকার কখনো লাঠিপেটা করেছে, কখনো টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে সুভেচ্ছা জানিয়েছে কখনো জনতাকে ঠেঙ্গিয়েছে। বয়সের ভারে ন্যূজ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নাজেহাল করেছে; পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের হাত-পা ভেঙে দিয়েছে; শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, গবেষক, বিশেষঞ্জ, সাদা মনের মানুষের গায়ে হাত তুলেছে। তারপরও ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকা বাম দলগুলো একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছে। অথচ বিএনপির ঘরে বসে মামলা খাচ্ছে; নিজেদের মধ্যে সংস্কারবাদী কট্টরপন্থীর দেয়াল তুলে বিবাদ করছে। পরিণতি জুলুম-নির্যাতন। বাংলাদেশের রাজনীতি তো বটেই পৃথিবীর কোথাও কোনো দেশে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের ঘায়েল করতে তাদের বিরুদ্ধে এক শ’ দেড় শ’ মামলা দেয়ার নজীর নেই। সে দৃষ্টান্ত হয়েছে। তারপরও দেয়ালের ভেতরে ‘নিরাপদে’ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। অথচ বিএনপির নিজেদের ভোটারদের ধরে রাখার চেষ্টা নেই। অপ্রিয় হলেও সত্য দেশের বেশির ভাগ সংখ্যালঘুর পরিচয় ‘নৌকার ভোটার’। অন্য দিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী, আলেম সমাজ, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও তৌহিদী জনতা ‘ধানের শীষের ভোটার’। ক্ষমতায় থাকায় জনবিচ্ছিন্নতা বাড়লেও আওয়ামী লীগ নিজের ভোটারদের খুশি রেখেই আলেম-ওলামা ভোটারদের দিকে হাত বাড়িয়েছে। ইসলামী চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসীদের ভোটে ভাগ বসাতে নিত্য নতুন কৌশল করছে। অথচ ভোটারদের পক্ষে টানার বিএনপির কোনো উদ্যোগ নেই। ভাবখানা আলেম-ওলামা, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, পীর-মশায়েখরা ধানের শীষে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়? পরিস্থিতি কী তাই? দলের দুর্দিনে নিজেদের নিরাপদে রেখে বিএনপির কেউ কেউ আগামীতে মন্ত্রী এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কেউ লন্ডন কানেকশনের স্বপ্ন দেখছেন। অথচ দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগার-আদালত ঘুরে পারিবারিক জীবন, ব্যক্তি জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছেন। যারা ঘরে বসে থেকে ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখছেন; তারা শুধু রাতকানা নয়, দিনকানাও বটে।
চলচিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরকে মানিকগঞ্জে বাসচাপায় হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ড্রাইভারের ১০ বছর কারাদন্ড দেয় আদালত। ২০০৩ সালে সাভারে এক মহিলাকে পিষে মারার হুমকি দিয়ে ট্রাকে পিষে পৈশাচিকভাবে হত্যা ঘটনায় ঘাতক ড্রাইভারের ফাঁসির রায় দেয়। একটা দুর্ঘটনায় হত্যা অন্যটা সরাসরি হত্যকান্ড। আদালতের দেয়া দুই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হঠাৎ ধর্মঘটে নামে পরিবহন শ্রমিকরা। উদ্দেশ্য কী? আদালতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শ্রমিকদের এই ধর্মঘটের ইন্দনদাতা হচ্ছেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতে ‘আদালতের রায় কারো পছন্দ না হলে রায়ের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় আপিল করা যায়’। পরিবহন শ্রমিকদের ভাবখানা এই যে, ‘আমাদের নূন্যতম বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবহন চালনার যথাযথ প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স থাকুক না থাকুক; আমাদের গাড়ির ফিটনেস থাকুক না থাকুক; আমরা রাস্তায় ইচ্ছামতো গাড়ি চালাব, মানুষ মারব। সরকার দুই টাকা ভাড়া বাড়লে ১০ টাকা আদায় করব। বাসে সিটিংয়ের নামে রড-ছাদ কোনোটাই খালি রাখব না। বাসের গায়ে লেখা থাকবে ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। যাত্রীরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আমাদের নেতা। তাই দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীকে আমরা থোড়াই কেয়ার করি। আদালতের রায় আমরা মানি না। আমরা মানুষ মারব, কিন্তু তার কোনো বিচার হতে পারবে না। আদালত বুঝি না, পড়ে দেখতে হবে এ জন্যে আমরা পড়ালেখাও শিখি নাই। আমরা যা বলব সেটাই আইন এবং সেটা রাষ্ট্র, জনগণ, সরকার এবং আদালতকে মেনে চলতে হবে। রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ মারার সার্টিফিকেট চাই। তাই আইনের পথে হাঁটেনি শ্রমিকরা। বরং অন্য প্রত্যাশায় মন্ত্রীর মদদে শ্রমিকরা ধর্মঘটের পথ বেছে নিয়েছে। সেই প্রত্যাশা কী? ‘ভাসুরের নাম মুখে নিতে নেই’ প্রবাদের মতোই নেপথ্যের রহস্য উদঘাটনে মিডিয়া, সুশীলসমাজ, সাংবাদিক কেউ আগ্রহী নন।
‘বামরা পারেন, আমরা পারি না কেন’ বিএনপি নেতা নাছির উদ্দিনের এই আত্মজিজ্ঞাসা এবং আত্মোপলব্ধি সময়ের সাহসী উচ্চারণ। কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষ লিখেছেনÑ ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর/কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার/পাঁচজনে পারে যাহা/তুমিও পারিবে তাহা/পার কি না পার কর যতন আবার/একবারে না পারিলে দেখ শতবার’। সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনীতির বাস্তবতায় আনুপাতিক হারে সিপিবি-বাসদ যদি ভোট পায় পাঁচটি; সেখানে বিএনপির ভোট পাঁচ লাখ। পাঁচজন সমর্থিত দল যদি গণমানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করতে পারে; দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জাতীয় সঙ্কট সমস্যার সমাধানের দাবিতে আন্দোলন করতে পারে; সীমান্ত হত্যা, তিস্তা চুক্তির দাবি, ৫৪ অভিন্ন নদীর পানির দাবি, দেশের সার্বভৌত্ব হুমকির মুখে ফেলে ট্যানজিট দেয়ার প্রতিবাদে ‘সরব’ হতে পারে; পুলিশের পিটুনি, লাঠিপেটা, গরম পানির জুলুম সহ্য করতে পারে; তাহলে পাঁচ লাখ লোক সমর্থিত বিএনপি কেন চার চেয়ালের ভেতরে বসে বিক্ষোভ করবে? রাজনীতির মাধ্যমে জনসেবা তো ‘মরার আগে মরে যাওয়া’ নয়?
পেশাগত কাজে দেশের ৩০টি জেলা ঘুরেছি গত তিন বছরে। জেলা শহর, উপজেলা শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম, চরাঞ্চলে কথা হয়েছে মানুষের সঙ্গে। ক্ষেতমজুর, শিক্ষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, বর্গাচাষি, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, গৃহিণী বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। পথে হাঁটতে হাঁটতে যেমন কথাবার্তা হয়েছে; নদীর ধারে, নৌকার ওপর ছইয়ে বসে মানুষর পাঁচালি শুনেছি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোট দিতে না পারায় তাদের মধ্যে যে হাহাকার; উপজেলা-জেলা পরিষদ-ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারায় যে বঞ্চনা; তারা সেটা অবলীলায় স্বীকার করেন। ক্ষমতায় কে এলো আর কে গেল সেটা গ্রামীণ মানুষের বিবেচ্য নয়; নির্বাচন হলো গ্রামের মানুষের কাছে উৎসব। তারা চায় ভোট দিতে; যেমন ’৭০ সালে চেয়েছিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে। গ্রামের লাখ লাখ মানুষ যে আত্মোপলব্ধি দুই আড়াই বছর আগে দেখেছি; সেই আত্মোপলব্ধি এখন দেখছি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে। মীর নাসিরের মনের গহীন থেকে যে ‘বেদনা’ উঠে এসেছে সে বেদনা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া সর্বত্র। গ্রামীর জনগোষ্ঠী এবং তৃণমূলে বিএনপির নেতারা দুই বছর আগে যে উপলব্ধি করেছেন; দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা সে উপলব্ধি করছেন এখন। অনেক দেরিতে হলেও এই উপলব্ধি কী জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কানার হাট-বাজারের শান্ত বাতাসকে উত্তপ্ত করতে পারবে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন