আফতাব চৌধুরী : বিশ্ব শান্তির ধারণা কবে বলা হয়েছিল তা বলা কঠিন। পনেরো শতকের পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বা মহাদেশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল সীমিত। ঔপনিবেশিকতাবাদের ফলেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্ব›িদ্বতা শুরু হয়। এই প্রতিদ্ব›িদ্বতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থিক দিকে প্রভাব বিস্তার করলেও বিশ্ব শান্তি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কোনো চিন্তার উদ্রেক করতে পারেনি। সেই সূত্রে বিশ্ব শান্তির ধারণাটি আপেক্ষিকভাবে নতুন বলা যায়। বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরুরা শান্তির মাধ্যমে মানব-কল্যাণ সৃজন করা যায় এই বলে মত প্রকাশ করেছেন। হযরত মোহাম্মদ (সা.) শান্তির বাণী প্রচারের মাধ্যমে মানবজাতিকে প্রকৃত পথের সন্ধান দিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় নেতা এবং সমাজ সংস্কারকেরা হিংসাবর্জিত সমাজ গঠনের জন্য শান্তির অনবদ্য চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বালাদেশের অবস্থান মোটেই কম নয়। এই দেশ ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের লোকের বাসস্থান। এই ধর্মগুলোর মর্মবাণীতে নিহিত আছে শান্তি এবং মানব কল্যাণের অনেক সৎ উপদেশ। সৃষ্টির শুরু থেকেই নারী এবং পুরুষ মিলে এই পৃথিবীতে মানব সভ্যতার সূচনা করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারী মাতৃ রূপে, সহধর্মিণী রূপে, ভগ্নী রূপে, সেবাপরায়ণা নারীর রূপে নিজের দায়িত্ব পালন করা হয় প্রতি বৎসরের মার্চের ৮ তারিখে। এই দিনটির তাৎপর্য হল, সেদিনই ১৮৫৭ সনের আমেরিকার বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক নারীর দৈহিক এগারো ঘণ্টার পরিবর্তে দশ ঘণ্টার শ্রম হ্রাস করার দাবির দ্বারা এবং নারীর অধিকারের কথা নিয়ে পৃথিবীব্যাপী নারী জাগরণের সূচনা হয়। পরে ১৯০৮ সনের মার্চ মাসের ৮ তারিখে নিউইয়র্কের মহিলারা প্রথম মহিলাদের ভোটাধিকার দাবি করে। সেই আন্দোলনের পর নারীর অনেক অধিকার সাব্যস্ত হয়েছে। এমনকী বিশ্বব্যাপী নারী জাগরণের জন্যই ১৯৪৫ সনে জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং ১৯৮৫ সনকে নারী দশক রূপে ঘোষণা করা হয়। নারীরা বিশ্বজয় করেছেন শান্তি, প্রেম, দয়ার মাধ্যমে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাদার তেরেজা। আর্তের সেবায় তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কলকাতার পথ থেকে তুেল এনেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী শিশুদের। হাসপাতাল থেকে যে রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হত তাদের তিনি আশ্রয় দিতেন। কুষ্ঠ রোগীদের চিকিৎসা আর মুমূর্ষু রোগীকে সেবা করা ও আশ্রয় দেওয়াই ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর নিষ্ঠুর দ্ব›েদ্বর মধ্যে মাদার টেরেজার এই অবদান অনির্বাণ দীপশিখার মতো। শান্তির জন্য তাকে ১৯৭৯ সনে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। অহিংসা বাণীর দ্বারা বিশ্ব বিজয়ীর তালিকাতে যুক্ত হয়েছে আরও তিনজন নারীর নাম। শান্তি, গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের প্রশ্নে নারীর অধিকার এবং অংশগ্রহণ অবিচ্ছেদ্য বলে ঘোষণা করে এই তিনজন নারী করেছেন বিশ্বজয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের সবলীকরণের বার্তা বহন করে ২০১১-র নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করা এই তিনজন মহিলা হলেন আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ইলেন জনসন সারলিফ, একই দেশের সমাজকর্মী তথা মানব অধিকার সংগঠক লেইমা গবউইল এবং পশ্চিম এশিয়ার কর্মী টাবাক্কুল কারমান। প্রথমবারের জন্য আফ্রিকীয় এবং আরব বিশ্বের কোনো মহিলা এইভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই ক্ষেত্রে নোবেল কমিটির অধ্যক্ষ থোবজোরেন জাগলেও বলেন “সমাজের প্রতিটি স্তরকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান নারীর সুযোগ আহরণ না-করা পর্যন্ত আমরা বিশ্বে চিরস্থায়ী শান্তি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত মহিলাদের উপর বাধা-নিষেধ দূর করে শান্তি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই মহিলা প্রতিনিধিদের বৃহৎ সম্ভাবনাকে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে এই পুরস্কারটি সাহায্য করবে বলে আমি আশাবাদী।” নারীর নিরাপত্তা এবং অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে অহিংস পন্থা ও সংগ্রামী পদক্ষেপের দ্বারা শান্তির সৌধ নির্মাণের জন্য এই তিনজন নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইলেন জনসন সারলিফকে ২০০৫ সনে ‘ভোটার দ্বারা রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে নির্বাচন করা হয়। লাইরেরিয়ার ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আফ্রিকার প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি সারলিফ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা একজন অর্থনীতিবিদ। গৃহযুদ্ধের আগুণ এখনও তার দেশে নেভেনি। জাতিসংঘের সহায়তায় নিজ দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য এখনো প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এই অর্থনীতিবিদ। সমস্ত লাইবেরিয়ায় তার পরিচয় সমাজসংস্কারক এবং শান্তিকর্মী হিসেবে। গৃহযুদ্ধের চক্রব্যূহ থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযান আরম্ভ হওয়া লাইবেরিয়ার মতো দেশের মানুষের প্রতি ৭২ বৎসরের সারলিফ তার নোবেল পুরস্কার উৎসর্গ করেন। ‘লৌহমানবী’ রূপে তিনি সেখানে বিখ্যাত। আরব বিশ্বের ৩২ বছরের টাবাক্কুল কারমান এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মহিলার সংগ্রামী সত্তার প্রতীক। সাম্প্রতিক বিশ্বের একাধিক দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে মিশর, টিউনিশিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া এবং বাহরাইনের মতো আরব বিশ্বের দেশগুলোতে গড়ে উঠেছে বৃহৎ গণআন্দোলন। এই আন্দোলনকে বলা হয় ‘আরব বসন্ত’। মিশরের অন্যতম নেত্রী আসমা মেহফুজের ভাষায়, ‘ইয়েমেনের টাবাক্কুল কারমানকে এই পুরস্কার দেওয়া মানে সমগ্র ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলনকে পুরস্কৃত করা।’ তিনি প্রগতিশীল ইসলাম ধর্মাবলম্বী মহিলা। টাবাক্কুল কারমান সম্পূর্ণ আচ্ছাদনে নিজের মুখাবয়ব আবৃত করে রাখতে অস্বীকার করেছিলেন। ইয়েমেনের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল ‘ইদুলাহে’-র একজন প্রথম শ্রেণীর সদস্য কারমান। আরব বিশ্বের কোনায় কোনায় স্বেচ্ছাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা বিদ্রোহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কারমানকে দেওয়া হয় নোবেল শান্তি পুরস্কার। এই বিষয়ে কারমান বলেন, “এই পুরস্কারটি আরববাসীর জন্য এক বিজয়। দীর্ঘ সময় ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি হয়ে থাকা আব্দুল্লাহ সালেহের একনায়কত্ববাদের অবসান ঘটাবে এই পুরস্কারটি।’’ তিনি আরও বলেন, তার সর্ববৃহৎ অনুপ্রেরণা হলেন মার্টিন লুথার, তারপর মহাত্মা গান্ধি এবং নেলসন ম্যান্ডেলা।লেইমা গবউইল, গৃহযুদ্ধের হিংসার বিরুদ্ধে লাইবেরিয়ার মহিলাদের একত্র করে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। এখন তার বয়স ৩০ বছর। ২০০২ সালে মুসলমান এবং খ্রিস্টান মহিলাদের একজোট করে লেইমা গড়ে তুলেছিলেন ‘ওমেন ফর পিস’। শান্তির জন্য মহিলার এই দলটি হাটে-বাজারে গিয়ে গান গেয়ে কন্যা শিশুদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে এই দলটি নির্ভয়ে ঘোষণা করেছিল ‘যৌন হরতাল’। লেইমার কার্যসূচি এখন ঘানা এবং সিরিয়া লিয়নের মতো দেশগুলোতে প্রভাব ফেলছে। ২০০৯ সালে সাহসিকতার জন্য তিনি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। সমগ্র বিশ্ব এবং আফ্রিকায় চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠাই তার একমাত্র লক্ষ্য। শান্তির নোবেল পুরস্কার লাভের পর তিনি বলেন, ‘এই পুরস্কার এই কথাটির সূচনা করছে যে আফ্রিকার সংঘর্ষ নিরাময় করার ক্ষেত্রে আফ্রিকার মহিলারা উন্নয়ন তথা সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবেন।’ একবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র মানবজাতি দুশ্চিতায় ভুগছে। মানুষ অণবিক প্রযুক্তি, দৈব প্রযুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে জ্ঞানের অবাধ প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ বিশ্বকে নিজের মুষ্টিতে এনে ফেলেছে। দয়া, মায়া ও ভ্রাতৃত্ববোধ আজ লুপ্তপ্রায়। শান্ত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কারও কোনও ভ্রƒক্ষেপ নেই। সব জায়গায় শুধু প্রতিযোগিতা। কাকে ছাড়িয়ে কে এগিয়ে যাবে, নিজের ভোগ সুখের জন্য কী করে অন্যের জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলবে অহরহ সেই চিন্তা। এই পরিস্থিতিতে নারীর মূল্য কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশ কংগো জাতিসংঘের দ্বারা বিশ্বের ধর্ষণ রাজধানী রূপে চিহ্নিত হয়েছে। সেখানে নারীর এই বিশ্বজয় এককথায় হৃদয়গ্রাহী। একটি সমাজ এবং পৃথিবী গড়তে হলে সেখানকার জনগণের উন্নতি সাধন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই মহিলা আর মহিলাকে বাদ দিয়ে কখনো সমাজ বা পৃথিবীর উন্নতি সম্ভব নয়। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, নারীরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সেই জন্য পুরুষ যে অধিকার পাবে তা নারীদেরও পাওয়া দরকার। নারীদের রান্নাঘরের চারপাশ থেকে বের করে সমাজমঞ্চে স্থান দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন