স্টাফ রিপোর্টার : ভারতের সাথে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি মেনে নেবে না বলে হুশিয়ারি দিয়েছে বিএনপি।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই হুশিয়ারি দেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ২৫ বছর গোলামী চুক্তি করেছিল ভারতের সাথে। উনার (প্রধানমন্ত্রী) এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে ভারতে যে সফর হবে, আমরা যেটা দেখতে পারছি, গুন গুন করে মানুষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, সংবাদপত্রেও এসেছেÑ একটা সামরিক চুক্তি হতে যাচ্ছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়, ভারতের কথা অনুযায়ী, ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা নীতি যদি গ্রহণ করতে হয়, তাহলে এদেশের স্বাধীনতা থাকবে না। এই ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে এদেশের জনগণ মানবে না, নিরাপত্তা বাহিনী মানবে না, কেউ মানবে না। তারা প্রতিরোধে এগিয়ে যাবে।
সকলকে সতর্ক থাকার আহŸান জানিয়ে রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফর সম্পর্কে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি থাকতে হবে। বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আমাদের চির স্থায়ীভাবে গোলামে পরিণত না করার প্রচেষ্টার জন্য আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। একবার ২৫ বছর চুক্তির মাধ্যমে যেভাবে দাসখত লিখে দেয়া হয়েছিল, সেটার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের উদ্যোগে বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১১তম কারাবন্দি দিবস উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়। ২০০৭ সালের এ দিনে তারেক রহমানকে ১/১১ সেনা সমর্থিত সরকার গ্রেফতার করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানও সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে প্রশ্ন তুলেন।
তিনি বলেন, সা¤প্রতিককালে পত্র-পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে একটি বিষয় আলোচিত হচ্ছেÑ যেটা হচ্ছে প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তি। আমি অন্যদৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে পর্যালোচনা করব, যেটি সম্পূর্ণ নির্মোহ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা এমন একটি ভূ-অবস্থানে অধিষ্ঠিত যার তিন দিকে রয়েছে একটি অত্যন্ত পরম বন্ধু রাষ্ট্র। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে, যে দেশের তিনদিকে একটি পরম বন্ধু রাষ্ট্র আছে, তাহলে প্রতিরক্ষার প্রশ্নটি উঠবে কেন? আর সেই প্রতিরক্ষা দেয়ার জন্য তিন দিকের যে বন্ধু রাষ্ট্র-তারা কেন এতো উৎসুখ হয়ে উঠেছে? আমার প্রশ্নটা হচ্ছে মৌলিক। আমি যে মৌলিক প্রশ্নটি তুলেছি, পত্র-পত্রিকায় উঠেছে, এই প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যেককে খুঁজে নিতে হবে। আমার যেখানে তিনদিকে বন্ধু রাষ্ট্র একটি দিকে সমুদ্র, সেখানে আমার তো কোনো প্রতিরক্ষা সমস্যা থাকার কথা নয়, তাহলে প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রশ্ন আসছে কেন? এসব প্রশ্নের জবাব সরকারকে দেশের মানুষকে দিয়ে দিক, আমাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন আসবে না।
রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ৫০ কোটি ডলার খরচ করবে ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য। কেন? একটা স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ, আমাদের নিরাপত্তা কেনো ভারতের ওপর নির্ভরশীল হবেÑ এটা সবচাইতে বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের সরকার কী বুঝতে পারছেন না, এই ধরনের নানা প্রক্রিয়া ও তামাশার মধ্য দিয়ে আজকে সিকিম ভারতের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। আজকে ভুটান অঙ্গীভূত না হলেও ভারতের করদমিত্র রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, ভারতের কারেন্সি সেখানে চলে, ভারতের সেনাবাহিনী সেখানে অবস্থান করে। আমরা ইনটার্মস অব পপুলেশন আমরা একটি বৃহৎ শক্তিশালী দেশ। আর এদেশে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী অনেক শক্তিশালী, আমাদের সেনাবাহিনী আছে, আমাদের বিমান বাহিনী আছে, আমাদের নৌ বাহিনী আছে। এখানে কিসের নির্ভরশীলতা, কার জন্যে নির্ভরশীলতা, কিসের চুক্তি?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, আমি আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দয়া করে প্রধানমন্ত্রী আপনি লেন্দুর দর্জি হতে যাইয়েন না। লেন্দুর দর্জির পরিণতি কিন্তু খুব খারাপ হয়েছে। পরে শিলিগুড়ির একটি অখ্যাত বস্তিতে তাকে অবস্থান করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আপনি, আপনার দেশের এতো জনসংখ্যা, সেখানে আপনি বাংলাদেশের নিরাপত্তা অন্যের হাতে তুলে দেবেনÑ এটা হতে পারে না।
চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনার প্রসঙ্গ টেনে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ভারতের সংবাদপত্রে এসেছে, সাউথ পোস্টে প্রতিবেদন এসেছে, সেটাকে উদ্ধৃত করে রিলায়েন্স গ্রæপে (ভারত) একটি পত্রিকা ‘ফাস্ট পোস্টে’ এসেছে যে, চীন থেকে দুটি সাবমেরিন বাংলাদেশ কেনার জন্য ভারত গোস্সা হয়েছে, অভিমান করেছে। তাই তাকে (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) অত্যন্ত আদর-আপ্যায়ন করতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডেকে নিয়ে গিয়ে ভারত সেখানে পবিত্র জলছিটিয়ে চায়নার প্রভাবমুক্ত করতে চায়।
আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভারত বলছে প্রতিরক্ষা চুক্তিÑ এটা বিপজ্জনক ব্যাপার। বাংলাদেশ সরকার চুক্তির কথা না বলে, এদিক-ওদিক করে বলছে। চুক্তির ভেতরে যে কী আছে, সেটা বলা মুশকিল। এর মধ্য দিয়ে কয়েকটি আশঙ্কার কথা আসতে পারে। আমি ২০০৫-৬ সালে দেখেছি, বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একসাথে বোম ফোটার পরে, ভারতের সব বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকরা বলেছেন, প্রি-অ্যামটিভ অ্যাটাক- আগাম আক্রমণ, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছেÑ এটা বুঝতে পারলে বাংলাদেশ সরকারকে না জানিয়ে ভারত এখানে সরাসরি আক্রমণ করবেÑ এই ধরনের কথা ওই সময়ে ভারতের ইন্টিলেজেন্সিয়ারা বলাবলি করেছিল।
এই সমস্ত চুক্তি বা স্মারক সইয়ের মধ্য দিয়ে ভেতরের যে বিষয়টি থাকবে, তা জনগণ জানতে পারবে না। এখন বাংলাদেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে এটাকে নাশকতা বলে চালিয়ে যদি এমন হয় যে, এখানে নাশকতার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে আমরা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে এসে অ্যাটাক করছি। তাহলে স্বাধীনতা কোথায় থাকল, সার্বভৌমত্ব কোথায় থাকল? এই ধরনের ষড়যন্ত্র তো আমরা দেশে দেশে দেখেছি। ওয়েপন অব মাস্ট ডিসটাকশনের কথা বলে ইরাকে আক্রমণ করা হলো, কিন্তু ইরাকে তো পেলো না।
রিজভী বলেন, এখন যদি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা স্বার্থকে আমরা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারাব। এর পরিণতি কী ভয়ংকর দিকে যাবে, সেটা এখন অনেক মানুষ বুঝতে পারছেন, এদেশের জনগণ উপলব্ধি করছেন।
‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’- দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই নীতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা নীতি এবং অর্থনীতির দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিক থেকে কারো উপর নির্ভরশীল নই। আমরা নিজের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রচনা করব, আমরা নিজেদের প্রতিরক্ষা নীতি রচনা করব, আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আসলে আমরা হৃদয় খুলে বন্ধুত্ব করব।
কিন্তু আমাদের মাটি ও মানুষকে যারা গোলাম বানাতে চায়, আমাদের মাটি যারা অপদখল করতে চায়, সেই এক ইঞ্চি মাটি আমরা কাউকে ছেড়ে দেবো না।
১/১১ সৃষ্টি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নির্যাতন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার বিষয়টি ‘একই সূত্রে গাঁথা’ বলে অভিযোগ করেন রিজভী।
২০১০ সালে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সরকারের ৫০টি চুক্তি হয়েছে, অনেক চুক্তি প্রকাশ করা হয়নি। এটা অত্যন্ত একটি বিপজ্জনক বিষয়। তারপরে এখন যেটা আশঙ্কা প্রকাশ করছিলাম, সেই প্রতিরক্ষা চুক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই কাজগুলো করবেন বলেই জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারাবাহিক নেতৃত্বকে বিপর্যস্ত করার জন্য ১/১১ সৃষ্টি হয়েছিল, তাদের (আওয়ামী লীগ) আন্দোলনের সফল তারেক রহমানকে নির্যাতন করা হয়েছে। দেখুন গতকালও (রোববার) বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এসব কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
দেশের আবহমান সাংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে ‘পরিকল্পতভাবে’ বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলে সয়লাব করে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন রিজভী। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল ভারতে চলে না, আমি দেখিনি। আমার নানার বাড়ি পশ্চিম বাংলায়, কয়েকবার সেখানে গেছি, ওখানে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে পায় বলে আমি শুনিনি। আর আমাদের দেশে ভারতের চ্যানেলে সয়লাব। বাংলাদেশের একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র আবহমানকালের সাংস্কৃতিক ¯্রােতধারাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি দিয়ে সয়লাব করে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা চলছে।
সভায় ড. মঈন খান বলেন, রাজনীতি মানুষের মৌলিক অধিকার। আর রাজনৈতিক দল নির্বাচন করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপি কখনো নিবন্ধন থাকা না থাকা জন্য রাজনীতি করে না।
সংগঠনের সভানেত্রী শামা ওবায়েদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরী, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন