আল আমিন মন্ডল : জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় বগুড়ার গাবতলী উপজেলা পর্যায়ে চার ক্যাটাগরিতে চার সংগ্রামী সফল বাংলার নারী নির্বাচিত হয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গাবতলী উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের উদ্যোগে যাচাই-বাছাই শেষে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে জয়িতা বাছাই করা হয়।
গাবতলী উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন মনিরা ইয়াছমিন। ‘সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা মোছাঃ রোকেয়া বেগম। ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছে যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা লিপি খাতুন ও ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা মোছাঃ আনিছা বেগম নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলার নারী ‘শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী’ জয়িতা হলেন গাবতলী হাসনাপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী ও দুর্গাহাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের (সমাজবিজ্ঞান) সহকারী শিক্ষক মনিরা ইয়াছমিন। তার পিতা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাতা গৃহিণী ও দুই বোন-দুই ভাইকে নিয়ে তার পরিবার ছিল। এর মধ্যে তিনি এসএসসি ও এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেন। মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় তিনি দারিদ্র্যকে জয় করে বিএ (অনার্স) এম এ পাস করেছেন। এরপরও তিনি থেমে থাকেননি। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকতা নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে নারী হিসেবে গাবতলী উপজেলায় সমাজ বিজ্ঞানে প্রথম নিবন্ধিত হন। সরকারি বিধি মোতাবেক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে তিনি নারী শিক্ষার প্রসার ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ আর্তমানবতা সেবায় কাজ করে আসছেন। তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে ও সমাজসেবামূলক কাজ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। ‘সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরিতে জয়িতা অন্বেষণে নির্বাচিত হয়েছেন নেপালতলীর কালুডাঙ্গা গ্রামের আলহাজ সামছুল হুদার স্ত্রী মোছাঃ রোকেয়া বেগম। তিনি জানান, পিতা-মাতাসহ আমরা ৬ বোন, ২ ভাই ছিলাম। নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বহু দুঃখ-কষ্টের মাঝে স্কুল পেরিয়ে কলেজে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। আমি বড় সন্তান হওয়ায় মা-বাবা ও ভাই-বোন সবাইকে সহযোগিতা করতে হতো। বাড়িতে রান্নাবান্না কাজ। এমনকি ঢেঁকিতে ধান-চাল ও আটা ভাঙার কাজ করতে হতো। মুখ্য সমাজে লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাকে ও পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমার বিবাহ হওয়ার পর সংসার জীবনে এসে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৮ সালে শিক্ষকতা পেশা শুরু করি। আমার স্বামীও বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ ছাড়াও আমার তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম পুত্র আরএসএম রেজা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, দ্বিতীয় পুত্র রাজু আহম্মেদ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ও তৃতীয় পুত্র আরএসএম রবিন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) থেকে পাস করে তিন সন্তানই অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্বসহ চাকরিরত রয়েছে। সব মিলিয়ে আমি আমার স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা ও খুব সুখে দিন কাটাচ্ছি। ফলে রোকেয়া বেগমের পরিবারে সুদিনের বাতাস বইছে। অপরদিকে ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছে যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন গাবতলীর নাড়–য়ামালা বাইগুনি জয়ভোগা মধ্যপাড়া গ্রামের আব্দুল গফুর প্রাং স্ত্রী লিপি খাতুন। তার ২০০৭ সালে বগুড়ায় বিয়ে হয়। ৮ম শ্রেণি পাস করার পর বিবাহ। ৮ মাসের মাথায় সংসারে নেমে আসে চরম দুর্দিন ও হতাশা। পরিবারে সাংসারিক ঝগড়াকলহ চলতে থাকলে একপর্যায়ে তার সংসার ভেঙে যায়। ফিরে আসে বৃদ্ধ পিতা-মাতার বাড়িতে। সেখানে দরিদ্র ও অসহায় পিতার সংসারে অসহায় ও একাকীত্ব জীবনযাপন করতে থাকেন। এরপর লিপির শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। নিজেকে স্বাবলম্বী করতে লিপি দর্জি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দর্জির কাজের পাশাপাশি তিনি যে অর্থ আয় করতেন সে টাকায় চলত পিতা-মাতা ও তার সংসার। লিপি জানান, স্বামীর নির্যাতনের কথা মনে পড়লে ‘গা’ যেন শিউড়ে ওঠে। এরপরও নিজের জীবনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পুরনো দিনগুলো পেছনে ফেলে রেখে আত্মস্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ফলে আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি আমি। সুস্থ-সুন্দর জীবন গঠনে নির্যাতনের বিভীষিকাকে প্রজ্বালিত করে আবারো নতুন উদ্যমে জীবনটাকে শুরু করেছি। আশা করছি জয়িতা অন্বেষণে আমাকে নির্বাচিত করায় আগামীদিনে আমার মতো অনেক নির্যাতিত নারী দরিদ্র জনপথে নারী ক্ষমতায়নে নতুন বিপ্লবের সূচনা হবে। সর্বশেষ ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হন মোছাঃ আনিছা বেগম। তিনি গাবতলীর পদ্মপাড়া গ্রামের আবু তালেবের স্ত্রী। ১৯৯০ সালে বিবাহ হলে তিনি ১ ছেলে ও ১ মেয়ের জননী হন। তার সংসার জীবনে পরিশ্রম ও স্বামীর অর্থে সংসার চলত। এরপরেও সে সমাজ ও জনকল্যাণমূলক কাজ করার জন্য তিনি ১৯৯৭ ও ২০১১ সালে ইউপি নির্বাচনে নারী সদস্য পদে নির্বাচিত হন। প্রশিকা সমিতির মাধ্যমে অসহায় বয়স্কদের নিরক্ষতা দূরীকরণে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। অসহায় নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান ও পুষ্টি প্রকল্প মাধ্যমে দুস্থ মহিলা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন তিনি। এমনকি তিনি বিপদের সময় অসহায় গর্ভবতী নারীদের হাসপাতালে পাঠানো ও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে তথ্যসেবা প্রদান করে আসছেন। আনিছা বেগম আরো জানান, গরিব ছেলেমেয়েদের বিবাহ, বাল্য-বহু বিবাহ রোধ, যৌতুক প্রতিরাধ, শিশু-মহিলা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, কিশোর-শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং মাদকাসক্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমাজে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে আসছি। এমনকি নারীদেরকে হাঁস-মুরগি পালন, সবজি চাষ ও কুঠির হস্তশিল্পের কাজে আগ্রহী করে তুলতে উৎসাহ প্রদান করে আসছি। এভাবে তিনি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র নারীদের ও সমাজ উন্নয়নে কল্যাণমুখী কাজ করে সমাজের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। এরপরেও তিনি নারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, কুসংস্কার দূরীকরণ ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে কাজ করছেন। বঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী করতে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও আনিছা বেগম একজন উদীয়মান অক্লান্ত পরিশ্রমী সফল নারী। নানা প্রতিক‚লতার সঙ্গে লড়াই করে সমাজ উন্নয়নে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। একদিকে তিনি নিজে স্বাবলম্বী, অপরদিকে সমাজ উন্নয়নে তিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়াও তিনি সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও দরিদ্রতা দূরীকরণে অবদান রেখেছেন। জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ গাবতলী উপজেলা পর্যায়ে কমিটির আহŸায়ক গাবতলী সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইউএনও (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রামকৃষ্ণ বর্মণ জানান, জয়িতা অন্বেষণে চার ক্যাটাগরিতে চারজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। চারজনেরই সমাজ ও জনকল্যাণমূলক কাজে ভিন্ন ভিন্নভাবে অবদান রয়েছে। সদস্য সচিব ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ আশরাফ আলী জানান, শতাধিক আবেদনের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে চারজনকে জয়িতা নির্বাচিত করা হয়। আশা করছি, নির্বাচিত বা বিজয়ী গাবতলীর চার জয়িতা আগামীদিনে সমাজ উন্নয়নে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন