রফিকুল ইসলাম সেলিম : রাস্তার উপর সবজি বোঝাই বেশ কয়েকটি ট্রাক। ওইসব ট্রাক ঘিরে অসংখ্য রিকশা ভ্যান। শ্রমিকেরা ট্রাক থেকে সবজি নামিয়ে ভ্যানে রাখছে। সড়ক দখল করে সবজি উঠা-নামার কারণে আশপাশে যানজট। দুইশ’ গজের ওই সবজির আড়তকে ঘিরে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট।
এ চিত্র দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ভিআইপি সড়ক হিসাবে পরিচিত বিমানবন্দর সড়কের চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার। ভোর থেকে শুরু করে প্রায় সারাদিন ওই আড়তে চলে সবজির কারবার। আর সড়ক দখল করে গড়ে উঠা এই আড়তের কারণে সেখানে যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। যানজটে স্থবির হয়ে পড়েছে মহানগরীর সব চেয়ে কর্মব্যস্ত ও গণবসতিপূর্ণ ওই এলাকা।
ভূক্তভোগিরা বলছেন, আড়তটি রাস্তা থেকে সরিয়ে সেখানে শৃঙ্খলা আনা গেলে যানজট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু শৃঙ্খলা আনার কোন উদ্যোগ নেই। ওই এলাকার মতো মহানগরীর প্রায় প্রতিটি সড়কে এখন চরম বিশৃঙ্খলা। আর এই কারণে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। যানজটে আটকা পড়ে নগরবাসীকে নিত্য চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। রাস্তায় আটকা পড়ে বিনষ্ট হচ্ছে মূল্যবান শ্রমঘণ্টা।
একের পর এক ফ্লাইওভার হচ্ছে, সম্প্রসারণ করা হচ্ছে রাস্তা ও সড়ক। তার পরও যানজট থেকে মুক্তি মিলছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে রাস্তা, ফুটপাত দখল, রাস্তার উপর অবৈধ বাস, টেম্পু ও টেক্সি স্ট্যান্ড, যত্রতত্র পার্কিং, গণপরিবহনে যেখানে সেখানে যাত্রী উঠা-নামা, অবৈধ ছোট যানবাহনের জোয়ার এবং মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণ, ওয়াসার পাইপ লাইন স্থাপনসহ সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এমন নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। এতে করে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও নাজুক হচ্ছে। পাহাড় আর সবুজ গাছ গাছালীতে ভরা দৃষ্টিনন্দন এই নগরীর যানজটের কারণে অসহনীয় দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নগরীর ২৪টি স্পটে পার্কিং সুবিধা, নির্ধারিত ছাউনিতে যাত্রী উঠানামা, বিমানবন্দরগামী যাত্রীদের জন্য সড়কে আলাদা লেইন স্থাপন এবং সড়কগুলোকে দখলমুক্ত করে স¤প্রসারণের উদ্যোগসহ গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নেয়া হয়। তবে এখনও তার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। একইসাথে ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল তখন। সিটি কর্পোরেশন ও নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা থাকলে তা হয়নি।
মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় যানজট এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। নগরীতে নেই কোন স্থায়ী বাস ও ট্রাক টার্মিনাল। যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানামা করা হচ্ছে। অবাধে চলছে অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন। ফলে গণপরিবহন এবং সেই সাথে মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। মহানগরীর লাইফ লাইন খ্যাত প্রধান সড়কের (বিমানবন্দর থেকে বহদ্দারহাট) পতেঙ্গা এলাকায় তিনটি সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে। পুরাতন তিনটি সেতু ভেঙে বিকল্প সেতুতে যানবাহন চলাচল করা হচ্ছে। এই কারণে ওই অংশে যানজট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। বিগত ২০১৫ সাল থেকে ওই এলাকায় এ অচলাবস্থা চলছে। গত বছরের ডিসেম্বরের সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলে তা হয়নি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ওই তিনটি সেতুর কাজ সরাসরি এলজিইডিকে তদারক করার দায়িত্ব দিয়ে দ্রæত সময়ে তা শেষ করতে বলা হয়েছে।
নগরীর ইপিজেড এলাকায় যানজট স্থায়ীরূপ নিয়েছে অনেক আগে। ওই এলাকায় রাতে দিনে তীব্র যানজট লেগে আছে। দেশের সর্ববৃহৎ ইপিজেড চট্টগ্রাম ইপিজেডে দুই লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। সকালে অফিস শুরু আর বিকেলে অফিস ছুটির পর ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সাথে তীব্র জনজট হয়। মহানগরীর অন্য এলাকায় দিনের বেলায় ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শুরু করে ইপিজেড ও পতেঙ্গা শিল্পাঞ্চলে ভারী যানবাহন চলাচল করে রাতে দিনে। ফলে ভারী যানবাহনের চাপে ওই এলাকার সড়ক এমনিতেই ব্যস্ত।
তার উপর সড়কের পাশে সবজির আড়ত বসার কারণে যানজট আরও তীব্র হচ্ছে। ব্যবসায়ী বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে ইপিজেড এলাকায় রাস্তা দখল করে গড়ে উঠা সবজির আড়ৎ সরিয়ে নিতে বার বার দাবি জানানো হলেও তা কার্যকর হয়নি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আড়ৎ এলাকায় দুইশ’ গজের কারণে অন্তত ৫ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজট হচ্ছে। সেখানে শৃঙ্খলা আনা গেলে যানজট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যায়। তবে এব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের কোন উদ্যোগ নেই।
প্রধান সড়কের মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ। সড়কের বিশাল অংশ দখলে নিয়ে নির্মাণ কাজের কারণে সরু অংশে চলছে যানবাহন। সড়কের ওই অংশের যানজট আশপাশের সড়কেও ছড়িয়ে পড়েছে। মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হিসাবে পরিচিত আগ্রাবাদ এক্সসেস রোড, পোর্ট কানেকটিং রোড, বহদ্দার হাট-কালুরঘাট-কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বহদ্দারহাট-শাহ আমানত কর্ণফুলী সেতু সড়কের অবস্থা এখন বেহাল। সড়কজুড়ে খানাখন্দের সৃষ্টি হওয়ায় তীব্র যানজট হচ্ছে।
মহানগরীতে নেই পর্যাপ্ত টার্মিনাল। রাস্তা দখল করে বাস ট্রাক রাখা হচ্ছে। নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বেসরকারি কন্টেইনার টার্মিনাল। এসব টার্মিনালের ভারী যানবাহন রাখা হচ্ছে রাস্তায়। নগরীতে চলাচলকারি গণপরিবহনও রাস্তা দখল করে পাকির্ং করা হচ্ছে। দূরপাল্লার বাসের কোন টার্মিনাল না থাকায় সড়কের পাশে কাউন্টারের সামনে রাস্তায় বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানামা করানো হচ্ছে। ফলে এসব এলাকায় যানজট হচ্ছে।
নগরজুড়ে এখন অবৈধ রিকশাসহ ছোট যানবাহনের জোয়ার। সিটি কর্পোরেশন অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধে বিশেষ করে ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার হুঁশিয়ারি দিলেও কোন অভিযান চোখে পড়ছে না। নগরীতে বৈধ রিকশার সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এর দ্বিগুন অবৈধ রিকশা চলছে রাস্তায়। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এসব রিকশাকে লাইসেন্স নিতে বলা হলেও তাতে সাড়া মিলেনি।
ব্যাটারি চালিত রিকশাও চলছে নগরজুড়ে। নগরীর বেশির ভাগ সড়কে চলছে টমটম ও বিশেষ ধরনের অটোরিকশা। এসব যানবাহন অবৈধ হলেও পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নগরীতে পরিবহন সংকট চলছে। রুট পারমিট নিয়েও অনেক বাস. মিনিবাস রাস্তায় নেই। এই সুযোগে ছোট যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা নিউমার্কেট, স্টেশন রোড, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, জিইসি মোড়, শোলশহর ২নং গেইট, চকবাজার, আন্দরকিল্লা, অংলকার মোড়, একে খান গেইট, বড়পুল মোড়সহ ব্যস্ততম মোড়ের ফুটপাত এমনকি রাস্তাও বেদখল হয়ে গেছে। এসব এলাকায় হাজার হাজার হকার তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ফুটপাত দখলমুক্ত করার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন