সকাল শুরু গুড মর্নিং দিয়ে। পরিবার থেকে অফিস পর্যন্ত ইংরেজির রিমঝিমে, নাট্যমঞ্চে হিন্দি গানের জমকালো আসরে, সিনেমা হলে হিন্দির বিনোদনে দিনরাত অবলীলায় ফুরিয়ে যায়। ডাক্তার বাবুও গরিব নিরক্ষর রোগীর ব্যবস্থাপত্র ইংরেজিতে লিখতে কার্পণ্য করেন না। আদালতের হাকিমও নির্ভিকচিত্তে বিচারকার্যে ইংরেজি ব্যবহার করে থাকেন। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটারে হাই-হ্যালো যেন আধুনিকতার বহিঃপ্রকাশ। একুশে ফেব্রুয়ারির (নামটা কিন্তু ফেব্রুয়ারি) রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউলসহ ভাষা শহিদদের তাজা রক্তের স্রোতধারা, তারুণ্যের অদম্যতা, স্বাজত্যবোধ, দেশপ্রেম ও মায়ের মুখের ভাষার প্রতি বাঁধভাঙ্গা সংগ্রামী চরিত্র, মাতৃভাষার জন্যে নিঃশেষে প্রাণদান বাঙালি সংস্কৃতির স্মৃতিচারণ করিয়ে দেয়। স্মৃতিপটে ভেসে যায় ১৯৫২ সালের (সালটা কিন্তু ইংরেজি) ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলা ভাষার দাবিতে বাঙালি দামাল ছেলেদের তেজদীপ্ত সংগ্রাম। ২১ ফেব্রুয়ারির আগমণী যেন আকস্মিক জাগরণীর জানান দিয়ে যায়। মনে করিয়ে দেয় বাংলা ভাষার স্বর্ণজয়ী ঐতিহ্য-সংস্কৃতির পরশবাণী। এ যেন আব্দুল গাফফারের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো’, অতুল প্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব, মোদের আশা’, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানের ধ্বনি হঠাৎ ঘুমের ঘোরে অবচেতন প্রায় শিশুর ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো। শিশুটি আবেগের তরঙ্গে ফেব্রুয়ারির সারাটি মাস ভেসে বেড়ায় একুশের চেতনা বুকের ভিতরে লালন করে। একুশের প্রথম প্রহরে কালো ব্যাজ ও শহিদ মিনারের ডিজাইনে পাঞ্জাবি সেলোয়ার পরে নগ্ন পদে, অবনত মস্তিষ্কে, ভারি যতেœ ও পরম আবেগে জনাকীর্ণতা উপেক্ষা করে পুষ্প বরণে স্মরণ করে রফিকদের অনবদ্য সংগ্রামের কথা। সশ্রুদ্ধ নীরবতা পালনে রফিকদের ঋণ স্বীকার করে। একুশে শহিদ মিনার যেন দুর্গন্ধ আর রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সিংহনাদ, যুগল-যুগলীর অবৈধ প্রেমালাপ থেকে মুক্তি পেয়ে পবিত্রতায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
এদিকে রফিক, সালাম, বরকতের পরিবার দু’মুঠো ভাতের জন্যে হাহাকার করছে তীর্থের কাকের ন্যায়। চিকিৎসার অভাবে রফিকের ভাই ধুকে ধুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। জব্বারের পরিবার অভাবের তাড়নায় বিত্তশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। ৬৩ বছরেও শনাক্ত হয়নি শহিদ সালামের কবর। পাবনার একমাত্র ভাষা শহিদের আজো মিলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ঘুমে কাতর অবুঝ শিশুটিকে বিজাতীয় সংস্কৃতির তন্দ্রা আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অপেক্ষায় রয় আগামী একুশের আগমণী বার্তার। কবরে শায়িত রফিক, সালাম, বরকতের আত্মা প্রতিধ্বনি করছে ভাইয়েরা! ঘুমিয়ে থেক না, জাতির ক্লান্তিকালে বিজাতীয় সংস্কৃতি দূরীকরণে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দাও। বিজাতী শোষিত নিষ্পেষিত বাংলা ভাষার জন্যে আরকেটি ভাষা আন্দোলনের ডাক দাও। আমরা রক্ত দেই নি একুশে ফেব্রুয়ারীর জন্য, আমরা রক্ত দিয়েছি, ৮ই ফাল্গুনের জন্যে, আমরা রক্ত দেইনি ১৯৫২ ইংরেজির জন্য, আমরা রক্ত দিয়েছি, ১৩৫৮ বাংলার জন্যে।
অজানা রহমান
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন