আলম শামস : প্রীতিজিপ চাকমা (১২)। পিতা আলো বিকাশ চাকমা। রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি পল্লী জীবতলায় তার বসবাস। প্রীতিজিপ ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী। বেশিরভাগ সময়ই সে থাকে অসুস্থ। জ্বর, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড লেগে থাকে। উপজেলার মগবান বড়ধন পাড়ার অনিমেষ চাকমার মেয়ে তাহি হিতে চাকমা (৩২)। তাহি হিতো বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে অসুস্থ। নানা রোগ-বালাই তার লেগেই থাকে। এছাড়া মেয়েলি রোগতো আছেই। জ্বর, ডায়রিয়া, জন্ডিস, আমাশয় পাহাড়ি জনপদের নারী ও শিশুর নিত্য সঙ্গী।
পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হাতের নাগালে চিকিৎসা সেবা নেই। তাই রোগ শোক নিয়েই এ জনপদের মানুষের জীবন কাটাতে হয়। বড় ধরনের কোন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে যেতে হয়। এ বিষয়ে তাহি হিতে চাকমার বাবা অনিমেষ চাকমা বলেন, আমরা বেশিরভাগ সময় জ্বর, ডায়রিয়া, টাইফয়েড রোগে ভুগছি। প্রায় প্রতি গ্রীষ্ম মৌসুমে জ্বর, ডায়রিয়া, জন্ডিস, হৃদরোগ লেগেই থাকে। এ দুর্গম পাহাড়ি পল্লীতে তেমন কোন চিকিৎসা সেবা নেই। চিকিৎসা নিতে হলে আমাদেরকে কাপ্তাই মিশন খ্রিস্টিয়ান হাসপাতাল বা কাপ্তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়। কিন্ত সেখানে বেশিরভাগ সময় ডাক্তার থাকেন না। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ডাক্তার পাওয়া গেলেও সরকারি ওষুধ জোটে না। হাসপাতালের রোগীরা তেমন কোন সু-চিকিৎসা পায় না। হাপাতালের পরিবেশ ভাল না। হাসপাতাল ভবন জরাজীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন ও অনিয়মে আচ্ছন্ন। মশা-মাছি আর দুর্গন্ধে চিকিৎসা ও নার্সিং সেবা পাওয়াতো দূরের কথা, হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকাই দায়। হাতেগোনা কয়েকটি এনজিও আছে, যারা মাঝে মধ্যে কিছু চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। তবে তাদের বাণিজ্যিক কাজ ও মিশনারি কাজেই বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ২৯১ জন। এদের প্রায় অর্ধেকই নারী। বাঙালি ছাড়াও এখানে ১৩টি নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। এরা হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বোম, পাংখোয়া, খুমি, চাক, লুসাই, উসাই, বনযোগী এবং খিয়াং। মোট জনসংখ্যার ৪৭% বাঙালি, ২৬% চাকমা, ১২% মারমা এবং ১৫% অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।
পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি জনপদের স্বাস্থ্যসেবা বিয়য়ে কাপ্তাই উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাসুদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, শুষ্ক মৌসুম এলেই সিজনাল জ্বর, টাইফয়েড, জলবসন্ত, চোখ ওঠা গলাফুলা রোগ হয়। তবে এখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপটা আগের ছেয়ে কম। দুর্গম এলাকায় কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। যদি কখনো বেশি সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে হাসপাতাল হতে মেডিকেল টিম পাঠিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তারা নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। নারীদের শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এলাকায় সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গণসচেতনতা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। পরিবার ও সমাজে স্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকায় বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরী, বাল্যবধূ, নববিবাহিতা, গর্ভবতী, দুধপ্রদানকারী মায়েরা রক্তস্বল্পতাসহ নানান জটিল ও কঠিন মেয়েলি রোগে ভোগেন।
এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা নিয়মিতÑ ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস, য²া, ক্যান্সার, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, রক্তশূন্যতা, মাতৃত্বকালীন জটিলতা, প্রসবকালীন সমস্যা, নবজাতকের মৃত্যু, কৃমিরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা ঘরে ও বাইরে কাজ করেন উদয়াস্ত। ফসলের মাঠে স্বামীর সাথে প্রেমময়ী স্ত্রী, আবার ঘরে স্নেহময়ী মার সেবাদানেও সমান ভ‚মিকা রাখছে নারীরা। এ নারী একজন সক্রিয় উপার্জনকারী। সন্তান জন্ম দেয়া, লালন-পালন করা ও ঘর-গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ এক হাতেই সামলাতে হয় তাকে। দেশের প্রতিটি মানুষের মতো তারও রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার। নারী হওয়ার সুবাদে কতিপয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেমন প্রজনন ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা। এটি নারী জীবনের খুবই স্পর্শকাতর সময়। একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারও। নৃ-গোষ্ঠী নারীর অবস্থান এখানে প্রান্তিক। আর তাই তার অবস্থান বড় বেশি নাজুক। সাধারণ বিচারে নৃ-গোষ্ঠী নারী হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার যে নির্ধারিত অবস্থান সেই অবস্থান সমাজে বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে আর দশটি মূল ধারার নারীর অবস্থান থেকে কিছুটা আলাদা। কিংবা সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অনুপস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও এটি একটি চলমান বাস্তবতা। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, কিংবা স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতার কারণে নৃ-গোষ্ঠী নারীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ কম। অধিকার ক্ষুণœ করা একটি সাংবিধানিক অপরাধ। স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চনার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃ-গোষ্ঠী নারীদের মধ্যে রক্তশূন্যতার ব্যাপকতা, প্রজনন সমস্যা, শিশু মৃত্যুর হার রীতিমতো অস্বাভাবিক। উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকির পাশাপাশি রোগ-বালাই, অসুখ-বিসুখ বৃদ্ধির প্রবণতা কিন্ত অনেক বেশি দৃশ্যমান। পরিবারে ও সমাজে উপেক্ষিত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এ নারী বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির সহজ শিকার। যুগ যুগ ধরে এ নৃ-গোষ্ঠী নারী শ্রমে ঘামে পরিবার পরিজনকে আগলে রাখলেও নিজের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন আজো নিশ্চিত করতে পারেনি।
একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, অশিক্ষা ও অসচেতনতা স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ। এখানকার পাহাড়ে বসবাসকারী প্রায় সকল বয়সী নারী পুরুষ ধূমপান ও মাদক সেবনে অভ্যস্ত। প্রাচীন রীতিনীতি ও কুসংস্কার থেকে এরা বেরুতে চায় না। রাজধানীর মিরপুরের ডিজিল্যাব মেডিকেল সার্ভিসেস-এর সার্জন ডা. জি.এম. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা অবহেলিত। উপযুক্ত স্বাস্থ্য সেবা না পেয়ে তারা বিভিন্ন রোগ-শোকে ভোগেন। জেলা ও উপজেলা শহরের কাছাকাছি যারা বসবাস করেন তারা কিছু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ সেবা একেবারেই অপ্রতুল। কিন্ত যারা নিতান্তই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে তাদের কাছে এনজিও স্বাস্থ্য কর্মীরাও যেতে পারে না। তাই দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীদেরকে স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধি নিয়েই জীবনযাপন করতে হয়। ডা. জাহাঙ্গীর হোসেন আরো জানান, স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধির বিবিধ কারণ রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- পরিবারে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, সমাজে স্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, ঋতুস্রাবকালীন অপরিষ্কার থাকা, পুষ্টি জ্ঞানের অভাব, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়া, ধূমপান ও মাদক সেবন, প্রাচীন রীতিনীতি ও কুসংস্কার, মদ্যপান, খাবার তালিকায় সুষম খাদ্যের অনুপস্থিতি, কাঁচা বন্যপ্রাণী ভক্ষণসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য তারা স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধিতে ভোগেন। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীসমূহ ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকায় সমাজে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাদের অবস্থানও দুর্বল। নারীর অবস্থান আরো নাজুক। ফলে বিভিন্ন বিরূপ ও প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে নারীকে কায়িক ও বাচনিকভাবে অমর্যাদাকর ও অসম্মানজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। নিজস্ব পরিমÐলের বাইরে অনেক সময় এসব নারীকে তার চেহারা, বেশ-ভুসার কারণে অহেতুক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এগুলো একজন নৃ-গোষ্ঠী নারী হিসেবে তার স্বীকৃত অধিকারের লঙ্ঘন। এসব কারণে নৃ-গোষ্ঠী নারী মানসিক ও শারীরিক পরিপুষ্টি অর্জন করতে পারছেন না।
বাসস-ইউনিসেফ ফিচার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন