তা রি ক জা মি ল : সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে খুব ঝাঁঝালো কণ্ঠের, চেতনা জাগানিয়া একটি
ভাষণ শুনতে পেল আরিফ। শুনল ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঠিক এমনই একটি বিপ্লবী বাণী পড়েছিল বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিততে। আরিফ ভাবলো এটা তাহলে বঙ্গবন্ধুরই অডিও ভাষণ। সে এটাও জানত যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাত্তর সালে বাঙালিরা পাকিস্তানী শাসকদের জুলুমের হাত থেকে বাঁচতে এবং নিজের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রক্তঝরা সংগ্রাম করেছিল। তার দাদুমণিও সে সংগ্রামের একজন সৈনিক। এর চেয়ে বেশি কিছু সে জানে না। আজ রাস্তায় ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে বেশ আগ্রহী হলো।
বাসায় ফিরে এসেই দাদুমণির কামরায় ঢুকল। দাদুমণি একান্ত মনোযোগের সাথে বই পড়ছিল। আরিফ কামরায় প্রবেশ করেছে এটা তিনি টের পাননি। আরিফ আড়াল থেকে দাদুর চোখ চেপে ধরে বলল নাম না বলতে পারলে ছাড়ব না। দাদুমণির নাম বলতে কোনো কষ্ট হয়নি। কেননা আরিফ ছাড়া দাদুর চোখ চেপে ধরার মত কোনো পিচ্ছি এবাড়িতে নেই।
দাদু বলল এবার হাত ছাড়ো। কিন্তু আরিফ বলল তার আগে তুমি আমায় ওয়াদা দাও যে, আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবে কিনা?
দাদু বলল ঠিক আছে ওয়াদা দিলাম গল্প শোনাব।
কখন শোনাবে?
সময় হলে আজ রাতেই শোনাব।
এবার চোখ ছাড়ল আরিফ।
ঠিক আছে তাই হবে, বলে মায়ের কামরায় চলে গেল আরিফ।
বিকাল গড়িয়ে রাত হলো। সন্ধায় দ্রæত পড়তে বসে গেল আরিফ। যত তাড়াতাড়ি পড়া শিখতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি গল্প শোনতে পাবে। রাত নটার পূর্বেই সব পড়া শিখে, খেয়ে-দেয়ে দাদুর রুমে হাজির হলো। তখন দাদু রুমে ছিলেন না। নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো দাদু। আরিফে দেখে তিনি মিটিমিটি হাসলেন। নামাজের পূর্বেই খাবার খেয়ে প্রস্তুত ছিলেন নাতিকে গল্প শোনাবেন বলে।
দাদু চেয়ারে বসে গল্প বলতে শুরু করল। আরিফ বিছানায় শুয়ে দাদুর মুখপানে চেয়ে থেকে এক ধ্যানে গল্প শুনছে। দাদু বলছে ‘একাত্তর সাল। সারাদেশ উত্তাল। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র -যুবক, নারী-পুরুষ সবাই জেগেছে। নিজেদের অধিকার আদায় করবে বলে। সাতই মার্চ উত্তাল জনসমুদ্রে ভাষণ দিলেন আমাদের মহান নেতা শেখ মুিজবুর রহমান। ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’
এই ঘোষণার পর সারাদেশে চলছে জালেমের মোকাবেলার প্রস্তুতি। এরই মাঝে পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। রাতের আঁধারে হাজারো মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। গ্রেফতার করে আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে। ওরা ভেবেছিল নৃশংসতা চালিয়ে স্তদ্ধ করে দিবে বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন। চিরদিন গোলামীর শিকল পড়িয়ে রাখবে বাঙালিদের। কিন্তু যারা বাঘের সাথে লড়াই করে বসবাস করতে জানে সুন্দরবনে।
তাদের দমাবে কে?
এবার সারাদেশের মানুষ বেরিয়ে পড়ল লড়াইয়ে। স্কুল -কলেজ বন্ধ দিয়ে সেগুলোতে ক্যাম্প বানিয়ে যুদ্ধ করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। স্বদেশী ঘাতকদের সহযোগিতায় প্রতিটা ক্যাম্পকে বানিয়েছিল ভয়াবহ নির্যাতন সেল। যেই স্কুলগুলো থেকে একসময় ভেসে আসত ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই ‘সেখান থেকেই তখন বের হতো নিপীড়িত মানুষের গোঙানী আর ধর্ষিত বোনের করুণ আর্তনাদ।
একদিন আমাদের চাচাতো ভাই হাফেজ বশির ঢাকা থেকে গাঁয়ে আসল। আমরা গাঁয়ের কিশোরেরা তার নিকট এসে জানতে চাইলাম ঢাকার অবস্থা সম্পর্কে। সে আমাদের খুব ভয়াবহতার কথা জানাল। আমাদের লজ্জা দিয়ে বলল, সারাদেশের মানুষ লড়াইয়ে নেমে পড়েছে তোমরা কিনা এখনো বসে রয়েছ। পরে আমরা তারই নেতৃত্বে দলবেঁধে নেমে পড়লাম যুদ্ধে। নদী পথে কীর্তনখোলা নদীর তীরে চরমোনাই মাদ্রাসায় গিয়ে উঠলাম। সেখান থেকে সেক্টর কমান্ডার এমএ জলিলের নির্দেশে চলে গেলাম ফরিদপুর। তেমন কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই দীর্ঘ লড়াইয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। কিন্তু হাফেজ বশির ভাইসহ বেশ কজন সাথিকে হারিয়েছি। আমিও আহত হয়েছিলাম। পা দেখিয়ে বলল এখনো গুলির দাগ রয়ে গেছে। এবার তিনি বললেন ‘পাকিস্তানীদের তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করেছি ঠিক কিন্তু এখনো স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠেনি ‘এখনো সীমান্তে রক্ত ঝরে তোমার বোন ফেলানীর। মার পেটেই গুলিবিদ্ধ হয় শিশু। গণধর্ষণের শিকার হয় নারী। ফুটপাতে দিন কাটে অসহায় মানুষের। এখনো মানুষ না খেয়ে মরে। বেড রুমে লাশ হয় সাংবাদিক দম্পতি।
অথচ আমরা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছি। দাদুমণি এবার
আরিফকে বলল : তুমি কি পারবে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে?
আরিফ অপলক নেত্রে দাদুর দিকে তাকিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে বলল : ইনশাল্লাহ!
দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করে, বিশ্বের বুকে সমুন্নত করব দেশের মর্যাদা।
মন্তব্য করুন