আলম শামস : ময়মনসিংহের মেয়ে মাহফুজা সেলিম। রাজধানীর সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর শেষ করে আউটসোর্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি ২০১০ সালে গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর কোর্স করেন। এরপর চাকরি খুঁজছিলেন। ২০১১ সালের প্রথমদিকে এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনেন ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে। তার কথা শুনে বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ নেন। ওই বছরে ওডেস্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে কাজ শুরু করেন। মাহফুজা সেলিম কাজ করছেন গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে। ‘চিলড্রেন’স বুক ইলাস্ট্রেশনের কাজ বেশি করেন। মূলত শিশুতোষ গল্পগুলোকে চিত্রে রূপ দেন তিনি। বর্তমানে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করেন। আগামীতে আউটসোর্সিং পেশাকে আরো ছড়িয়ে দিতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট দিতে চান মাহফুজা। তিনি মনে করেন, তার এখনো শেখার অনেক বাকি রয়েছে। তাই নিজেকে আরো ভালোভাবে তৈরি করতে চান তিনি। শুধু টাকার জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজ করছেন তিনি।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে একচেটিয়া বিচরণ ছিল পুরুষদের। মূল কারণ কম্পিউটার তথা আইসিটি খাতে শিক্ষা, সেবা ও ব্যবসায় যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। পাল্টেছে এ চিত্র। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে এসেছেন তথ্যপ্রযুক্তিতে। যদিও পোশাক শিল্প, ক্ষুদ্র ঋণ, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষকতা, গবেষণা, ব্যাংকিংসহ অন্যান্য খাতে নারীর পদচারণা তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে।
এমনিতেই বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের মাত্র শতকরা ৫ ভাগ তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। সেখানে নারীর অবস্থান তো খুঁজে না পাওয়ারই কথা। আশার কথা, নারীর এ খাতে অংশগ্রহণ কম হলেও যোগ্যতায় পিছিয়ে নেই। তবে যেটুকু হয়েছে প্রায় সবটুকুই বেসরকারি খাতে। কম্পিউটার প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলের মতো বিষয়গুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ কম হলেও আইসিটি খাতে নারীদের সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে এ সুযোগের সম্ভাবনা আরো বেশি। কারণ, অর্থনীতিতে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা দেশের নারীরা আইসিটি খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন এবং এ খাতেই কর্মজীবন ও পেশাজীবন গড়ার কথা ভাবছেন।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থা পরিচালিত ‘তথ্য আপা : ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প’-এর ওয়েব এডমিনিস্ট্রেটর মো. সাইফুল ইসলাম নারীর তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় সরকারি উদ্যোগ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার নারী শিক্ষায় খুবই আন্তরিক, বিশেষ করে মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চলমান আছে। এর মধ্যে ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প’, ‘জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্প’, ‘নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প’ উল্লেখযোগ্য। এসব প্রকল্পে লাখ লাখ নারীকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা প্রদান করা হয়েছে। নারীরা তথ্যপ্রযুক্তি তথা কম্পিউটার বা আইসিটি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজ উদ্যোগে আউটসোর্সিং, কম্পিউটার রিলেটেড ব্যবসার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। কৃষি, স্বাস্থ্য, আইন, জেন্ডার ও ব্যবসা সম্পর্কে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ওঠোন বৈঠকের মাধ্যমে নারীকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।’
তিনি আরো জানান, বর্তমানে সরকারের তথ্য আপা প্রকল্পে নানা বয়সী নারীরা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নিতে আসেন, তবে ১৮-৩৫ বছর বয়সী নারীরা বেশি আসেন। তথ্য প্রযুক্তি বা আইসিটি শিক্ষা গ্রহণ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে অনেক নারীই অর্থ সংকটে ভোগেন। এ সংকট সমাধানে কর্মসংস্থান ব্যাংকে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বা ট্রেনিংপ্রাপ্তদের ঋণ প্রদানে অগ্রাধিকার রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি বেসরকারি সকল ব্যাংকই তথ্যপ্রযুক্তি তথা আইসিটি প্রতিষ্ঠান বা ফার্মকে খুব কম সুদে ঋণ প্রদান করে।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে প্রচুর কর্মসংস্থান। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতেও উচ্চপ্রযুক্তির দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসেবেও দেখা যায়, দিন দিন বিশ্ব আইসিটির বাজারের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। হয়তো আইসিটিতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহারে মোটেই পিছিয়ে নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৬ থেকে ৫৪ বছর বয়সী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারী ও পুরুষদের সংখ্যা প্রায় সমান। কাজেই আইসিটি খাতে ওয়েবভিত্তিক অনেক কাজ আছে যেগুলো ঘরে বসেই করা যায়। যেহেতু ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে নেই, তাই এ ধরনের কাজ করার সুযোগ নারীদেরই বেশি।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আইসিটিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য কাজ করেছে ডিনেট। এ প্রতিষ্ঠানটির তথ্যকল্যাণী বা ইনফোলেডি প্রকল্প ব্যাপক সাড়াও ফেলেছে। সাইকেল চালিয়ে একজন তরুণী মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। সঙ্গে ল্যাপটপ বা নেটবুক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তিনি কখনও স্বাস্থ্যসেবা দেন, আবার কখনো গ্রামের মেয়েদের বা স্কুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার ব্যবহার শেখান। এদের নাম ‘ইনফো-লেডি’ বা ‘তথ্যকল্যাণী’। তথ্যকল্যাণীরা তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক সেবাকে নিয়ে যাচ্ছেন সরাসরি গ্রামীণ জনগণের দরজায়।
নানা বাধা পেরিয়েও দেশের আইসিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা নারীর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়োজিত নারীরা নিজেদের অবস্থা সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছেন। বাংলাদেশেও গড়ে উঠছে এমন সংগঠন। তেমনি একটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’ বা বিডব্লিউআইটি। সংগঠনটির নারীরা কোন না কোনভাবে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতে পেশাগতভাবে জড়িত নারীদের এখন পর্যন্ত প্রধান সংগঠন এটি। সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য আইটি খাতের সঙ্গে জড়িত নারীদের একত্রিত করে তাদের পরিচিতির ব্যবস্থা করা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করা। সংগঠনটি তরুণীদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে এবং এই শিল্পে উদ্যোগী হতে উৎসাহিত করে থাকে। নারী উদ্যোক্তা এবং পেশাজীবীদের আইসিটিতে সাফল্য অর্জনের জন্য নেতৃত্ব গুণাবলীসহ অন্যান্য দক্ষতা বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টাও করা হয় এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে। কাজেই যে নারীরা বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সঙ্গে যুক্ত তারা খুব সহজেই বিডব্লিউআইটির সদস্য হতে পারেন।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বিশাল জনশক্তিকে প্রযুক্তির জ্ঞানে জ্ঞানী করতে পারলে তারা আমাদের বোঝা না হয়ে তারা হবে দেশের সম্পদ। আমাদের দেশে অনেক নারী ঘর থেকে বের হতে চায় না। তাদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজের ঘরে বসে আউটসোর্সিং ফ্রিল্যান্সিং করে দেশি-বিদেশি প্রচুর মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। স্বল্প শিক্ষিত নারীদের সামান্য প্রশিক্ষণ দিতে পারলে ভালো একটি সফলতা পাওয়া যাবে।
গ্রাম-গঞ্জের পিছিয়েপড়া শিক্ষিত নারীদের আইসিটি খাতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের হাতকে কাজে লাগাতে হবে। তাহলে আগামীতে আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় উন্নয়নে নারীর সাফল্য পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে। জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
আইসিটি খাতে একজন নারী যদি তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেন, তবে সামাজিক ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় গোড়ামি অনেকাংশে কমে আসবে। তাই নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেক পরিবর্তন ঘটছে। তরুণ সমাজ এখন সামজিক সাইটের মাধ্যমে তথ্যের আদান প্রদান করছে। তবে এত কিছুর পরেও এখানে একটি 'জেন্ডার ডিভাইড' রয়ে গেছে। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে গ্রামগঞ্জের আইসিটি খাতে নারীদেরকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় উদ্যোগ সরকারি-বেসকারি পর্যায়ে নিতে হবে।
বাসস/ ইউনিসেফ ফিচার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন