মি জা নু র র হ মা ন : সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। নদীমাতৃক এ দেশে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত এবং ঋতুভিত্তিক। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন হিসেবে ধার্য হয়ে আসছে সুদূর অতীত থেকে। বলা যায়, বাংলা সন গণনার সময়পর্ব থেকে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির এই শুভ সূচনা। আর এই বাংলা সনের গোড়াপত্তন যদি আমরা অনুসন্ধান করি তাহলে পাই যে, মোঘল বাদশাহ মহামতি আকবর এই সনের গোড়াপত্তন করেছেন। স¤্রাট আকবর যখন দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীকে দিয়ে নতুন ফসলি সন বের করান, তার মাথায় ছিল রাজস্ব আদায়ের সুবিধা। এটি যখন চালু হয় তখন গ্রেগরিয়ান বা তথাকথিত খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জিতে ১৫৮৪। একে কার্যকর করা হয় আটাশ বছর আগের সময় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে, যা ছিল আকবরের সিংহাসনে বসার আনুষ্ঠানিক বছর। তখন হিজরি ৯৬৩ সাল। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরতের সাল থেকে গণনা শুরু হওয়া হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর প্রচলিত চান্দ্র হিজরি সন ফসল কাটার সময়ের সঙ্গে না মেলাতে রাজস্ব আদায়ের জন্য অসুবিধাজনকই বিবেচিত হচ্ছিল; তাই নতুন কিছুর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই ফসলি সন রাজত্বের পূর্বাঞ্চলে কালক্রমে বাংলা সনের নাম নেয়; এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কালে-কালে তা শুধু বৃহত্তর বাংলাতেই নয়, বাঙালিরা যেখানে আছে, ত্রিপুরা, আসাম, বিহারসহ সর্বত্র ও বাইরের ডায়াস্পোরায়, সবখানে তা জীবনের অংশ হয়ে গেছে। তবে বাংলা সনের প্রবর্তকের বিষয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ উপর্যুক্ত মতটিকে গ্রহণ করেছেন। তবে অনেকেই রাজা শশাঙ্ক বা নেপালি কোন স¤্রাটকেও মনে করেন। লোক গবেষক, প্রাবন্ধিক শামসুজ্জামান খান তার এক লেখায় বাংলা নববর্ষের প্রচলন, সন-তারিখ ও পঞ্জিকা নিয়ে তার দীর্ঘ ৪৩ বছরের গবেষণায় লিখেছন: ‘আনুষঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ এবং ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের বিচার-বিবেচনা করে আমরা মোগল সুবেদার (পরবর্তীকালে নবাব) মুর্শিদ কুলি খানকেই বাংলা সনের প্রবর্তক বলে মনে করি। তবে তিনি আকবর-প্রবর্তিত ‘তারিখ-এ-এলাহি’র সূত্র অনুসরণ করেই বাংলা অঞ্চলের কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন এমনই ধারণা করি। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তা হলে স¤্রাট আকবর পরোক্ষভাবে এই সনের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমন মনে করা যেতে পারে।’
যেহেতু বাংলা নববর্ষ নিয়ে আলোচনা করছি, সেহেতু এই প্রয়াশে বাংলা বর্ষের বার মাসের নাম ও সপ্তাহের সাতদিনের নামকরণের খুঁটিনাটি জেনে নেয়া যেতে পারে। বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে । বাংলা মাসের এই নামগুলি হল:
বৈশাখ, বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে;
জ্যৈষ্ঠ, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামানুসারে;
আষাঢ়, উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নামানুসারে;
শ্রাবণ, শ্রবণা নক্ষত্রের নামানুসারে;
ভাদ্র-উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নামানুসারে;
আশ্বিন, অশ্বিনী নক্ষত্রের নামানুসারে;
কার্তিক, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামানুসারে;
অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ), মৃগশিরা নক্ষত্রের নামানুসারে;
পৌষ, পুষ্যা নক্ষত্রের নামানুসারে;
মাঘ, মঘা নক্ষত্রের নামানুসারে;
ফাল্গুন, উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামানুসারে ও
চৈত্র, চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে।
স¤্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী-র মাসের নামগুলি প্রচলিত ছিল ফারসি ভাষায়, যথা: ফারভারদিন, উর্দি বেহেস্ত, খোরদাদ, তির, মোরদাদ, শাহরিভার, মেহের, অবান, অযার, দেই, বাহমান এবং ইসফান্দ।
বাংলা দিনের নামকরণের ইতিহাস খুঁজলে আমরা পাইযে, বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামÐলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।
শুক্রবার হচ্ছে শুক্র গ্রহের নামানুসারে;
শনিবার হচ্ছে শনি গ্রহের নামানুসারে;
রবিবার হচ্ছে রবি বা সূর্য দেবতার নামানুসারে;
সোমবার হচ্ছে সোম বা শিব দেবতার নামানুসারে;
মঙ্গলবার হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের নামানুসারে;
বুধবার হচ্ছে বুধ গ্রহের নামানুসারে ও
বৃহস্পতিবার হচ্ছে বৃহস্পতি গ্রহের নামানুসারে।
এবার আসি নববর্ষের দিনের কার্যাবলীর আলোচনায় যে কিভাবে এই সর্ববৃহৎ ও সর্বজনীন উৎসবটি পালিত হয়। বাঙালিদের সর্ববৃহৎ এ উৎসবকে পালনের জন্য সারাদেশে চলে নানা আয়োজন ও অনুষ্ঠানমালা। দেশের সর্বত্র পড়ে যায় সাজ সাজ রব। যে সকল অনুষ্ঠানমালা করে নববর্ষকে বরণ করে নেয়া হয় তন্মধ্যে প্রথমটি হলো রমনার পাকুড়মূলে (প্রচলিত আছে বটমূল হিসেবে। প্রকৃত এটা যে গাছটি অশ্বত্থ বা পাকুড় গাছ।) সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ছায়ানটের বৈশাখ বরণ গান গেয়ে। এখন আরেকটি সাড়া জাগানো কর্মসূচী যোগ হয়েছে এই বর্ষবরণে সেটি হল মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো (টঘঊঝঈঙ) ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটির ১১তম অধিবেশনে এটিকে অধরা সাংস্কৃতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। সে হিসেবে এটি এখন বৈশ্বিক সংস্কৃতির অঙ্গ।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গ্রাম-গঞ্জে নানা উৎসব-পার্বণ পালিত হয়। বৈশাখের এসব উৎসব-পার্বণ মানুষকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। একে অন্যের সাথে আত্মীয়তা তৈরি হয়। বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আমানি, পুণ্যাহ ও গম্ভীরার মত কর্মসূচী পালিত হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের গ্রামীণ মেলায় বাংলার লোকশিল্প পল্লবিত হয়। চোখ জুড়ানো রং-বেরঙের হাঁড়ি-পাতিল খেলনায় ভরে ওঠে মেলা-প্রাঙ্গণ। বৈশাখী মেলার প্রাঞ্জলতা মানুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে। এসব মেলাতে বসে কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর জম্পেস নানা ধরনের পসরা। থাকে নানা রকম পিঠাপুলির আয়োজনও। অনেক জায়গায় ব্যবস্থা থাকে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার আয়োজন। নানা ধরনের খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়ে থাকে বৈশাখকে সামনে রেখে। এসবের মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা ও কুস্তি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি বসে ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে বিশেষভাবে পরিচিত। এদিকে ঈশা খাঁর সোনারগাঁয়ে বসে এক ব্যতিক্রমী মেলা, যার নাম বউমেলা। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে এই মেলার আয়োজিত হয়ে আসছে। পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলাটি বসে প্রাচীন একটি বটগাছের নিচে। যদিও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সেখানে সমবেত হয় সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা উপলক্ষে। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাদের মনষ্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করে থাকেন। মিষ্টি ও ধান-দূর্বার সাথে মৌসুমি ফল নিবেদন করেন ভক্তরা। এ ছাড়া মেলাকে ঘিরে পাঁঠাবলির রেওয়াজও বেশ পুরনো। তবে কালের বিবর্তনে বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন ভক্তরা কবুতর উড়িয়ে শান্তির বার্তা প্রার্থনা করেন দেবীর কাছে। অন্যদিকে সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আয়োজন করা হয় ঘোড়ামেলার। এ মেলা নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত আছে, যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ওই জায়গাতে বানানো হয় তার স্মৃতিস্তম্ভ। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে হিন্দুরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং সেখানে আয়োজন করে মেলার। যার কারণে মেলাটির নাম হয়েছে ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করা। এরপর সেই খিচুড়ি কলাপাতায় করে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই খায়। একদিনের এই মেলাটি জমে ওঠে মূলত দুপুরের পর থেকে। মেলায় সবচেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ করা যায় শিশু-কিশোরদের। মেলাতে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে রাখা হয় নাগরদোলা, পুতুলনাচ ও সার্কাসের। এ ছাড়া মেলার ক্লান্তি দূর করতে যোগ হয় কীর্তন গান। খোল-করতাল বাজিয়ে এ গানের আসর চলে অনেক রাত পর্যন্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের মধ্যেও নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়ে থাকে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন