আরব নিউজ : ইসলামী বিশে^র সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের এক যুগ সন্ধিক্ষণে ইসলামের পবিত্রতম দু’টি স্থান যে ভূখন্ডে অবস্থিত সেই সউদি আরবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম সফরে লাল, সাদা ও নীল (অবশ্যই সউদি সবুজও) রঙের পূর্ণ প্রদর্শনী দেখা গেছে। সউদি বাদশাহ সালমান কর্তৃক ট্রাম্পকে বিশাল অভ্যর্থনা জ্ঞাপন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র মিডিয়ায় প্রথম পৃষ্ঠায় ঠাঁই পেয়েছে। আমেরিকার সর্বাধিক পঠিত অনলাইন নিউজ এগ্রিগেটর দি ড্রুজ রিপোর্ট ব্যানার হেডলাইন করেছে- ‘বাদশাহর পক্ষে যোগ্য সম্বর্ধনা।’
রিয়াদে ট্রাম্পের সংবর্ধনার প্রভাব এতই ব্যাপক হয় যে সউদি সংবর্ধনার মান ও মাত্রার সাথে তাল মিলাতে ইসরাইল ট্রাম্পের জন্য সোমবার তার নিজের সংবর্ধনা কর্মসূচিতে শেষ মুহূর্তে পুনর্বিন্যাস করে।
সংবর্ধনার মহাসমারোহের পিছনে যা আছে তার পুরোটাই বাণিজ্য। তােেদর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী রেক্স টিলারসন ও সউদি পরারষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবেইর এ সফরের ঐতিহাসিক সময় এবং তাদের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিষয়ে পুনরঙ্গীকার ও তা শক্তিশালী করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
ইরান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোন অবস্থানে আছে তা নিয়ে সন্দেহ সামান্যই আছে। এ অঞ্চল জুড়ে (কার্যত বিশ^জুড়েই) সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর প্রতি তেহরানের অব্যাহত পৃষ্ঠপোষকতা তার দেশ ও সউদি আরবের প্রতি এক জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি হয়ে আছে বলে টিলারসন পুনরুল্লেখ করেন।
আমেরিকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সমাবেশ এবং বিনিয়োগের ব্যাপারে উভয়পক্ষের প্রতিশ্রæতি যা তুলে ধরেছে তা হচ্ছে আমাদের দু’দেশ পারস্পরিক কল্যাণকর স্বার্থে আবদ্ধ। আমেরিকার রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ভাষ্যকাররা জোর দিয়ে বলেছেন যে রিয়াদ শীর্ষ বৈঠকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তি হাজার হাজার না হলেও শ’ শ’ লোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। অন্য কথায় ট্রাম্পের এ সফর সকল পক্ষের জন্য বিজয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সউদি আরবে ট্রাম্প ও ব্রান্ড আমেরিকার প্রতি প্রকৃত ও হৃদয়গ্রাহী তৃণমূল পর্যায়ে সাড়া রয়েছে। আমেরিকা ও আরবের মধ্যে সাংস্কৃতিক ছেদের বিষয়টি সুন্দরভাবে সস্প্রচারিত হয় যখন সউদিরা হার্লি ডেভিডসনের মোটর সাইকেল র্যালিতে এবং দেশের সঙ্গীত কনসার্টগুলোতে জড়ো হয়, স্টেডিয়ামে আমেরিকার জাতীয় সংগীত বেজে উঠলে আনন্দ প্রকাশ করে। সউদি বাদশাহর সাথে ঐতিহ্যবাহী অর্ধনৃত্যে ট্রাম্প ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল এমন এক দৃশ্য যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের আগামী প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য লেখা হয়ে থাকবে।
রিয়াদ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিদেশ সফরের প্রথম গন্তব্য। মার্চে সউদি উপ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওয়াশিংটন সফরকালে এ সফরসূচির ভ্রুণ রচিত হয়। ইনসাইডার্স এ সফরকে সফল বলে আখ্যায়িত করেছে।
সউদি উপ যুবরাজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সন্ত্রাস দমন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়েই আলোচনা করেননি, যুক্তরাষ্ট্রে সউদি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সউদি আরবে আরো বেশী আমেরিকান কোম্পানির ব্যবসার পথ মসৃণ করার কথাও আলোচনা করেন।
সর্বোপরি ৫০টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের শীর্ষ বৈঠকে ট্রাম্পের অংশগ্রহণ একটি ইতিবাচক বিষয় যেখানে উগ্রবাদ মোকাবেলা এবং এ অঞ্চলে ইরানের ক্ষতিকর হস্তক্ষেপ হচ্ছে প্রধান বিষয়। একই সাথে সেখানে এই বিষাক্ত প্রচারণারও পাল্টা জবাব দেয়া হবে যে যুক্তরাষ্ট্র বিশে^র একশ’ কোটিরও বেশী মুসলমানের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর যুদ্ধে লিপ্ত।
যুক্তরাষ্ট্র ও সউদি আরবের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই কেন্দ্রাভিমুখতার ব্যাখ্যা করেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচ. আর. ম্যাকমাস্টার। তিনি বলেন, ট্রাম্পের সফরের প্রধান লক্ষ্য হবে শান্তি জোরদার করতে আমাদের আরব ও মুসলিম অংশীদারদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করা এবং তাদের সহায়তা করা যারা ইসলামিক স্টেট (আইএস) থেকে আল কায়েদা থেকে ইরান থেকে বাশার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
এখানে বার্তা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম বিশ^ তাদের তাদের নিরাপত্তার জন্য অভিন্ন শত্রæ ও হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এখানে অধিক কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল আল কায়েদা ও আইএসের মত ইরান ও সিরিয়া প্রশাসনকে অস্থিতিশীলতাকারী বলে আখ্যায়িত করা।
বারাক ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতির সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির পরিষ্কার ফারাক এখানেই। ওবামা প্রশাসন ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরে একান্থভাবে কাজ করেছিল এবং সউদি আরব তাদের কাছ থেকে শীতল আচরণ পেয়েছিল।
সউদি আরবের সাথে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত। কৌশলগত পর্যায়ে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র লাভে ইরানের উচ্চাকাক্সক্ষার বয়স কয়েক দশক। এদিকে ইরান তার শিয়া জঙ্গি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করতে চাইছে যা আরব বিশ^ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি।
এর অর্থ ইরাক ও সিরিয়ার রণাঙ্গনে মার্কিন সৈন্য এবং সউদি আরব ও ইয়েমেনে আরব জোট সৈন্যরা ইরানি সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির বিশাল উচ্চাকাক্সক্ষার ফলে হুমকিগ্রস্ত।
ইরাকে ইরানের প্রধান জঙ্গি কমান্ডার কায়েস খাজালি গত সপ্তাহে এক বক্তৃতায় এ অঞ্চলে শিয়া অর্ধচন্দ্রকে এক পূর্ণাঙ্গ চাঁদে সম্প্রসারিত করার সক্রিয় প্রচেষ্টার কথা আলোচনা করেন।
ট্রাম্প সউদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে মুসলিম ও আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। তার কথায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আইএসকে উগ্রবাদের দিকে নেয়া ও ইরানের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে বাড়তে দেয়ার ওবামার শূন্যগর্ভ নীতি এখন অতীতের বিষয়। আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী আরো শক্তিশালী হবে।
*নিবন্ধকার কুবাই শাবন্দর প্রতিরক্ষা দফতরের সাবেক উপদেষ্টা এবং বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগর বিষয়ক কৌশলগত যোগাযোগ কনসাল্টিং বিশেষজ্ঞ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন