চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানার অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। বন্দরনগরী ও বাণিজ্যক রাজধানী হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম মহানগরী এবং তার সন্নিহিত এলাকায় ভারী, মাঝারী, ক্ষুদ্র-সব ধরনের শিল্প-কারখানাই গড়ে উঠেছে। এক সময় এসব শিল্প-কারখানা রাতদিন কর্মঞ্চল থাকলেও এখন অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ বা অচল হয়ে গেছে। অনেক শিল্প-কারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। কোনো কোনো শিল্প-কারখানা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অর্ধশতাধিক বছরের পুরানো বৃহাদায়তম শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলি পেপার মিল অচলাবস্থার মুখে, কর্ণফুলি রেয়ন মিল বন্ধ, চিটাগাং স্টিল মিলস অনেক আগেই উধাও, চিটাগাং ইউিিরয়া সার কারখানা চলছে জোড়াতালি দিয়ে। কালুরঘাঁট, নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী ও সীতাকুÐ এলাকায় দুডজনের বেশী পাটকল, বস্ত্রকল, কার্পেট মিলসহ ভারী শিল্প-কারখানা বন্ধ। এখন এগুলোর অধিকাংশই গুদাম বা গোচারন ভূমি, কোনো কোনো শিল্প-কারখানার জায়গায় গড়ে উঠেছে রিরোলিং মিল। মাঝারি, এমনকি ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। ভারী ও বৃহৎ শিল্প-কারখানা সচল-সক্রিয় থাকলে অন্যান্য শিল্প-কারখানাতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সুপরিচিত ও বিখ্যাত শিল্প-কারখানাগুলোর বন্ধ বা প্রায় অচল হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ এগুলোর প্রতি যথেষ্ট নজর দেয়া হয়নি। অব্যবস্থাপনাসহ অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট এই নাজুক ও দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক শিল্পের বিকাশ যতটা হওয়ার কথা ছিল তা হতে পারেনি নানা কারণে। জমির অভাব, গ্যাস- বিদ্যুৎ সংকট, চোরাই পণ্যের দৌরাত্ম্য এসব কারণে উদ্যোক্তরা এগিয়ে আসেননি সেভাবে। বিনিয়োগের জন্য চট্টগ্রাম দেশের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান হলেও উদ্যোক্তারা এসব কারণে নিরৎসাহ। উপযুক্ত স্থানে শিল্প-কারখানার বিস্তার-বিকাশ না হওয়া দেশের জন্য কোনো ভালো খবর হতে পারে না।
পাকিস্তান আমলে শিল্প শহর বা শিল্প এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হতো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং কিছুটা হলেও বগুড়া। স্বাধীনতার পর সারাদেশেই কমবেশী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রথম গার্মেন্ট কারখানা, প্রথম ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামেই। অথচ সেখানেই শিল্পের বিস্তার বাধাগ্রস্ত বা রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা না পেলে কোনো উদ্যোক্তাই শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে এগিয়ে আসেন না। জমির অভাব, ব্যবসা শুরু করতে বিলম্ব, নানা প্রকার হয়রানি ও অতিরিক্ত অর্থব্যয়, ঋণের উচ্চ সুদহার, গ্যাস-বিদ্যুতের অনিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অস্থিরতার আশঙ্কার কারণে বিনিয়োগ ততটা বাড়েনি, যতটা সম্ভাবনা ছিল। বিনিয়োগ না বাড়লে উৎপাদন, রফতানি, কর্মসংস্থান, কোনো কিছুই প্রত্যাশানুগ হতে পারে না। হয়ওনি এবং হচ্ছেও না। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। চট্টগ্রামে সম্ভাবনা বেশী; তাই আশাও বেশী। আবার সম্ভাবনা ও আশা পুরন না হওয়ায় হতাশাও বেশী। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হলো সমুদ্র বন্দর। সমুদ্র বন্দরকে ঘিরেই এখানে শিল্প-কারখানার সূচনা ও বিকাশ ঘটে। শুধু ভারী ও মাঝারি শিল্পের নয়, ক্ষুদ্র শিল্পেরও সম্প্রসারন ঘটে; অনেক ক্ষেত্রে ভারী ও বৃহৎ শিল্পের সহযোগী ও পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প হিসাবে। চট্টগ্রামে শিল্পের সম্ভবনা ততদিন থাকবে যতদিন বন্দর এই সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখবে। চট্টগ্রামের শিল্পের ঐতিহ্য ও অবারিত সম্ভবনা কাজে লাগাতে পারলে শিল্পের ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাবে এবং উৎপাদন-অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ভূরাজনৈতিক কারণে চট্টগ্রাম উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কর্মকাÐের একটি বিশাল কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। চীনসহ পাশ্ববর্তী অনেক দেশই চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী। চট্টগ্রামে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ব্যাপক আকারে উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো, অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা ইত্যাদি রয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বাস্তবায়ন পর্যায়ে এলে সবচেয়ে বড় অভাব যে জমির, সেই জমির অভাব থাকবে না। অর্থনৈতিক অঞ্চল-ইপিজেডে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে পারবে। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কার্যকর করতে গেলে অবশ্যই অবকাঠামো উন্নয়ন ও গ্যাস-বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের উন্নয়ন সাধনেরও কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গতকারণেই আমরা আশা করবো, বন্ধ ও প্রায় অচল হয়ে পড়া শিল্প-কারখানাগুলো সচল করার কার্যব্যবস্থা সরকার নেবে। সম্ভব না হলে নতুন অন্য কোনো অথবা একই শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেবে। রাস্তাঘাট, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহন ইত্যাদির উন্নয়ন-সংস্থান-নিশ্চয়তা বিধান করবে। আমরা চট্টগ্রামের শিল্প ক্ষেত্রগুলোকে সদা কর্মচঞ্চল অবস্থায় দেখতে চায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন