শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ফেইসবুকে বিনা পূঁজির ব্যবসা

| প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগ নারী : ১০ হাজার পেইজে চলছে কেনাবেচা
ফারুক হোসাইন : কর্ম ব্যস্ততা, যানজটসহ নানা কারণে মার্কেটবিমুখ হচ্ছে নগরবাসী। আর এতেই জনপ্রিয় উঠছে অনলাইন মার্কেট। অনলাইন শপিংয়ের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক। বিনা পূঁজিতে ফেইসবুকে পেইজ খুলেই ব্যবসায়ী বনে যাচ্ছেন অনেকেই। ফেইসবুকে পেইজ তৈরি করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাতে বিক্রি করছেন দেশি বিদেশি নানান ধরণের পণ্য। আর ফেইসবুক কেন্দ্রীক বিপণনে উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই নারী। এসব অনলাইন পেইজে নারীদের জন্য শাড়ি থেকে শুরু করে সালোয়ার, দেশিয় হস্তশিল্পের জুয়েলারি, বিদেশি জুয়েলারি, দেশি-বিদেশি প্রসাধনী পণ্যের আসরই বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়া দেশীয় বাজারে সহজলভ্য নয় এমন ‘এক্সক্লুসিভ প্রোডাক্ট’ কেনার জন্যও দারুণ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেইসবুক পেইজগুলো। বাদ যাচ্ছে না স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসক পরামর্শও।
উদ্যোক্তা এবং ক্রেতারা জানান, গৃহবধু থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পণ্য ও সেবা দিয়ে আয়ের পথ তৈরি করছেন আবার এদের মধ্য থেকেই ক্রেতা। ফেইসবুক উদ্যোক্তারা আরও জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন শপিংয়ের সবচেয়ে সহজ হলো এর জন্য কোন পূঁজির প্রয়োজন হয়না। প্রয়োজন নেই কোন বাড়তি জায়গা বা লোকবলেরও।  বিক্রেতার সঙ্গে ফেইসবুক পেইজে বা ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়। কোনো পণ্য না থাকলেও ফেইসবুকের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তা আনিয়ে দেয়। উদ্যোক্তাদের মতে, নতুনদের পাশাপাশি  বিশ্বের বড় মাপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করছে ফেইসবুক। অল্প পুঁজিতে, এমনকি বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায়। কোনো দোকান ঘর লাগে না, ব্যবসা পরিচালনা করা যায় ঘরে বসেই। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এ মাধ্যমটি।
ফেইসবুক পেইজ খুলে পণ্য বিক্রি করছেন এমন একজন উদ্যোক্তা নওরীন আক্তার। তিনি বলেন, তার পেইজে লাইক বাড়ছে সাথে সাথে বিক্রিও বাড়ছে। তিনি বলেন, ফেইসবুকে তার একটি পেইজ আছে যেখানে তিনি হ্যান্ড মেড পণ্য বিক্রি করেন। বিশেষ করে হ্যান্ড মেড জুয়েলারি। নওরীন বলেন, নিজে পড়ার জন্য শখের বসে প্রথমে গহনা তৈরি করতাম। এগুলো দেখে আশপাশের অনেকেই প্রশংসা করতো। অনেকেই আবার চেয়ে নিত। এ থেকেই আমার হ্যান্ড মেড গহনা বিক্রির চিন্তা মাথায় আসে। এসময় আমি অনলাইনে অনেক সময় ধরে ফেইসবুকিং করতাম। কিন্তু তেমন প্রোডাক্টিভ কিছু ছিল না। এক সময় মনে হয় ফেইসবুকে অযথা সময় কেন নষ্ট করব?  আর সেখান থেকেই ফেইসবুকে অনলাইন শপ-এর কাজ শুরু করি। এখন আমার পেজের লাইক ১৪ হাজারের কাছাকাছি। তাছাড়া পণ্যে প্রচুর সাড়াও পাচ্ছি। আমরা ঢাকায় হোম ডেলিভারি দেই। আর ঢাকার বাইরে কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠাই। নওরীন মনে করেন, ফেইসবুকে এই অনলাইন শপিং-এর সম্ভাবনা বিশাল। গৃহবধু থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইনে পণ্য ও সেবা দিয়ে আয়ের পথ খুঁজছেন। আবার তারাই অনলাইন ক্রেতা।  
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেইসবুক পেইজে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে সুতি, জামদানি, মসলিন, সিল্কের শাড়ি, মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক, আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, শার্ট, জিন্স প্যান্ট, আমদানি করা জুয়েলারি, ঘড়ি, চশমা, চামড়ার বেল্ট, ওয়ালেট, ঘর সাজানোর সামগ্রী, বিউটি কেয়ার প্রডাক্টসহ নানা পণ্য।
অনলাইন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সভাপতি ফাহিম মাশরুর জানান, বাংলাদেশে দু’ধরনের অনলাইন শপ আছে। এক ধরনের হলো যারা নিজোরই ওয়েবসাইট খুলে পণ্য কেনা-বেচা করেন। আরেক ধরনের হলো ফেইসবুকে পেইজ খুলে কাজ করেন। ফাহিম মশরুর বলেন, ওয়েবসাইট ভিত্তিক বড় ধরনের অনলাইন শপ ৪০টির মতো আছে এখানে। তবে ফেইসবুকে কতগুলো আছে তা বলা মুশকিল।
বাংলাদেশে এখন ফেইসবুক ভিত্তিক ই-কমার্স সবচয়ে দ্রæত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইক্যাব)-এর সভাপতি রাজীব আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন ওয়েবসাইট ভিত্তিক এক হাজার এবং ফেইসবুক ভিত্তিক ১০ হাজার ই-কমার্স সাইট আছে। ২০১৬ সালে আমাদের হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে৷ প্রতিদিন ডেলিভারি দেয়া হয়েছে ২০ হাজার অর্ডার৷
ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে নিয়মিত কেনাকাটা করা ইমরান মাহমুদ বলেন, যে কোন পণ্য কিনতে চাইলে বিভিন্ন পেইজে ঘুরে ফিরে দেখা যায়। এছাড়া পেইজগুলোতে লাইক দিয়ে রাখার কারণে যে কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনই ফেইসবুক খুললেই দেখা যায়। তিনি জানান, একটু ভিন্নধর্মী গিফট আইটেম চাইলে ফেইসবুক থেকে পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া বিদেশি কসমেটিকস পাওয়া যায় এমন পেইজেরও কমতি নেই। একটু ‘সার্চ’ করলেই পেয়ে যাবেন পছন্দসই জিনিস। ফেইসবুক পেইজে অনলাইন একটি শপের নাম ‘এ সেল বিডি’ যেখানে পাওয়া যায় তরুণদের সৌখিন বিভিন্ন পণ্য। ব্যবসা শুরুর সময় এবং বর্তমানে বেচাকেনার কেমন পার্থক্য জানতে চাইলে পেইজের সত্ত¡াধিকারী জাকির হোসেন বলেন, আগে খুব বেশি বিক্রি হতো না। তবে বর্তমানে প্রতি দিন গড় ৫০ থেকে ৬০ টা অর্ডার আসে সারাদেশ থেকে। যা আমরা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে দিই। ক্যাশ অ্যান্ড ডেলেভারি অর্থাৎ পণ্য হাতে পাওয়ার পর ক্রেতা পণ্যের দাম পরিশোধ করে যে কারণে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ‘শৌখিন ফ্যাশানের’ কর্ণধার বিলকিস ইরানী জানান, ইদানিং ফেইসবুক ভিত্তিক অনলাইনের জনপ্রিয়তা অনেক গুণে বেড়েছে। আমার যেহেতু পণ্যের সিংহভাগ লেডিস আইটেমের কালেকশন, সেহেতু বছরের সব সময় ক্রেতাদের চাহিদা থাকে। তবে ঈদ, পূঁজা, বিশেষ দিবসে চাহিদা অনেক বেশি হয়। তিনি আরো বলেন, ২০১৩ সালে শুরু করা ফেইসবুক ভিত্তিক আমার এই অনলাইন শপে সবচেয়ে বড় সুবিধা ক্রেতারা যেটা পাচ্ছেন, সেটা হল ঘরে বসে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন। আর অনেক ক্ষেত্রে এই দাম শপিংমলের দামের থেকেও কম থাকায় ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
তবে কেনাকাটার বিষয়ে রাজীব আহমেদ বলেন, ফেইসবুকে কেনাকাটা করার সময় বা আগে, যে পেইজ থেকে কিনতে যাচ্ছেন বা অর্ডার করছেন সেই পেইজ এবং এর কর্ণধার সম্পর্কে ভালো করে জেনে নেওয়া ভালো। কারণ অনেক সময়ই ‘ফেইক পেইজে’র পাল্লায় পড়ে ভুগতে হয়েছে অনেককেই। ফেইসবুক থেকে পণ্য কেনার বিষয়ে যেমন ভোগান্তিহীন তেমনি মাঝে মাঝে অনেকেই প্রতারণার অভিযোগও করেন। যে পণ্য অনলাইনে দেখানো হচ্ছে ডেলিভারির সময় দেখা যায় অনলাইনের ছবির সাথে পণ্যের মিল নেই। এই বিষয়ে রাজীব আহমেদ বলেন, প্রতারণা আছে তবে তা শতকরা হিসেবে কম। কেউ প্রতারিত হলে অভিযোগ করতে পারেন তিন জায়গায়। কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন, ভোক্তা অধিকার ফোরাম এবং আমাদের ইক্যাব-এ। তিনি আরও বলেন, অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোতে প্রতারণা হয় সবচেয়ে বেশি। কারণ এখানে মার্কেট প্লেস সরারি পণ্য বিক্রি করে না। বিজ্ঞাপন দেখে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পণ্য কেনাবেচা হয়। এজন্য নীতিমালা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন ফাহিম মাশরুর।  
এদিকে দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোক্তা হয়ে ফেইসবুক পেইজে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি এই মাধ্যমটি জনপ্রিয় হওয়ায় এখন ওয়েবসাইটের বাইরেও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ খুলেও বেচাকেনা হচ্ছে বিভিন্ন জিনিসের। ফেসবুকে এমন একটি পেজের নাম স্টাইল ওয়ার্ল্ড কালেকশন। পেজটিতে গিয়ে দেখা যায়, গতকাল পর্যন্ত ১৬ লাখ ১৫ হাজারেরও বেশি লাইক রয়েছে। সেখানে মেয়েদের জন্য শাড়ির বিপুল সমাহার। পাশাপাশি ছেলেদের পোশাকও রয়েছে। এই একি নামে গুলশানের একটি শপিং মলে তাদের দোকান রয়েছে। স্টাইল ওয়ার্ল্ডের মালিক মিস পলি বললেন, ২০০৫ সাল থেকে তিনি ঐ শপিংমলে দোকান দিয়েছেন। বেচাকেনা খুব একটা খারাপ ছিল না। তবে গত চার বছর হল তিনি ফেসবুকে একটি পেজ খুলে তার দোকানের সব পণ্যের ছবি আপলোড করাতে বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ।
এবিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বেসিস-এর সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর জানান, অনলাইনে সবচেয়ে বড় সুবিধা ক্রেতারা যেটা পাচ্ছেন, সেটা হল ঘরে বসে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন। আর অনেক ক্ষেত্রে এই দাম শপিংমলের দামের থেকেও কম থাকায় ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
রিপন ১১ জুন, ২০১৭, ৩:২৭ এএম says : 0
এখন সময়টা অনলাইন ফেইসবুকের। তাই মানুষ এই দিকে ঝুঁকছে।
Total Reply(0)
তুষার ১১ জুন, ২০১৭, ৩:২৮ এএম says : 0
ঘরে বসেই মানুষ সব কিছু পাচ্ছে। তাহলে বাইরে কেন যাবে?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন