শাহানাজ বেগম
গত ৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছে বিশ্ব নারী দিবস। নারীরা তার পরিপূর্ণ অধিকারের দাবিতে সুদীর্ঘকাল যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, তারই সম্মানস্বরূপ এ দিনটি পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে। এনিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম হয় না। নারীর আবার বিশেষ দিন কি? বা বাকী সবই পুরুষের, এ জাতীয়। কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর ভূমিকা পুরুষের কর্মকা-ের বিভিন্ন ধারায় কম-বেশি অবদান অনস্বীকার্য। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে নারী। আজ অবধি নারী কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনসহ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে পুরুষের পাশেই নারীকে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও নারী ভূমিকা অনেক কিন্তু, কাক্সিক্ষত দাবি নারী সমাজ অর্জন করতে পারেনি। কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ২০০৯-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে পুরুষের চেয়ে নারী ১৬ ভাগ পারিশ্রমিক কম পায়। অপর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে নারীরা কাজ করছে শতকরা ৬৫ ভাগ। নারীরাই এই জগতের শক্তির উৎস আর প্রেরণা
পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত প্রায় সমান। ঘরে বাইরে নারীর পদচারণা সবখানেই। অফিস আদালতে তাদের কাজের স্বীকৃতি পেলেও মেলেনি গৃহস্থালী কাজের। সেখানে আজও আর্থিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বলে নারীরা অর্থনৈতিক মূল্যে অদৃশ্যই থাকে। অন্যদিকে, কখনও শ্লিলতাহানি বা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হতে হচ্ছে নারী বা শিশুর।
শিক্ষিত নারীরা অফিস আদালতে কাজ করছে ঠিকই, আবার হত দরিদ্র বা অশিক্ষিত নারী কখনও গৃহে কখনও মাঠে ফসলের কাজ করছে। বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, পার্লামেন্টের স্পিকার ও সংসদ উপনেতা একজন নারী। হিমালয়ের চূড়া আরোহণ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, সচিব, এসপি, ডিসি, ওসি সবই হয়েছেন বাংলাদেশের নারীরা। নারীরা বিমান চালাচ্ছে, ট্রেন চালাচ্ছে, খেলাধুলায় সাফল্য অর্জন করছে। তারা সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ অর্জনসহ প্যারাশুটার হিসেবে সাফল্য অর্জন করেছে। ঢাকা শহরে নারী সার্জেন্ট। নারীর এই নতুন রূপ মেয়েদের কাজের গতিকে আরো স্পৃহা জোগাচ্ছে। পুরুষ সহকর্মীদের পাশাপাশি ২২ নারী সার্জেন্ট রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যানজট নিরসনে তারা দিন-রাত পুরুষ সার্জেন্টের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা বনানী, গুলশান, মতিঝিল, কাওরান বাজার, বাংলামোটর ও বাড্ডায় তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বড় কথা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার সকল উন্নয়ন কার্যক্রমকে জেন্ডার রেসপনসিভ করেছে। ইতিহাসের পাতায় নারী দিবসের কথার সাথে সাথেই ক্লারা জেটকিনের অবদানের কথা স্মরণ করতেই হয় । ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা ন্যায্য হিসাবের দাবিতে রাস্তায় নামে। ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে ব্যর্থ হয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন পুরুষের পাশাপাশি নারীর সম-অধিকারের দাবিটি আরও জোরালো করেন। ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয় ৮ মার্চ। এরমধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারংশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনেগ্রো, রাশিয়া, তাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম, জাম্বিয়া। চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার, নেপালে শুধুমাত্র মেয়েরাই সরকারি ছুটি পায়। শুধু দেশেই নয়। পৃথিবী জুড়েই চোখে পড়ে নারীর ক্ষমতায়ন। প্রথমেই চোখ যায় মার্কিন রাজনীতিবিদ হিলারির দিকে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য এবং নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সিনেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। হিলারি ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের স্ত্রী। রাজনীতিতে প্রবেশের পূর্বে হিলারি আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। জন্ম ও শৈশব শিকাগো ইলিয়নসে হিলারী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালে। আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন যোগ্য প্রার্থী হিসেবে লড়ে যাচ্ছেন।
এবারে চোখ রাখি জার্মানীর দিকে। জার্মানে চ্যান্সেলর হিসেবে তৃতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। দেশটির এসপিডির পার্লামেন্ট সদস্যরা প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যার্কেলের জোটকে সমর্থন দেয়ার পক্ষে ম্যার্কেল ৬২১ সদস্যের মধ্যে ৪৬২ জনের ভোট পান। অ্যাঙ্গেলার বাবার পরিবার কিছুটা পোলিশ বংশোদ্ভূত। ১৯৭৭ সালে মেরকেল নামে এক ভদ্রলোককে বিয়ে করেন অ্যাঙ্গেলা। মেরকেল তাঁর প্রথম স্বামী। বিয়ের পরই তার নাম হয়ে যায় অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। পূর্ব জার্মানি থেকে পেয়েছেন নিয়মশৃঙ্খলা! ফুটবলের ভীষণ ভক্ত অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। অন্যদিকে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। মিস রুসেফ ব্রাজিলে গত ১২ বছর যাবত ক্ষমতায় থাকা ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধিত্ব করছেন। ফিরে তাকাই মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী সুচির দিকে। মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে অং সান সুচি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। এর ফলে দেশটিতে চলা ২৫ বছরের সামরিক শাসনের অবসান হতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশের বেশি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত ফলাফল থেকে জানা যায়, নির্বাচনে এনএলডি দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয় লাভ করেছে। যা দেশটির সংসদে সরকার গঠন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার জন্য যথেষ্ট। দলটি সংসদের উভয় কক্ষই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। সুচি প্রায় এক দশক দেশটির সামরিক জান্তাদের হাতে গৃহবন্দি ছিলেন। পুরুষের পাশে নারীর এই শক্ত অবস্থান নজির আরো অছে। শারিরিক কষ্ট সহ্য করে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে শুরু করে শিক্ষকতা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ট্রেন চালনা, বিমানের পাইলট বা এভারেস্টের চুঁড়ায় উঠছে নারী। কঠিন পরিশ্রমকে ভয় পেয়ে বা হতাশ না হয়ে দুরন্ত বেগে এগিয়ে গেছে দেশে দেশে নারীরা। ফলে পেশায় লিঙ্গ ভেদাভেদের কোনো সুযোগ নেই। পুরুষের পাশাপাশি নারীর এগিয়ে চলা জাতির উন্নয়নের বার্তা বয়ে আনে। যে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক সহায়তাও প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন