সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ

| প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা গণহত্যার মুখে পাঁচলক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের পর অবশেষে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। এতদিন ধরে রোহিঙ্গাদের বাঙালী মুসলমান বলে দাবী করলেও এখন মূলত আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত চাপের মুখেই তারা এই নীতিগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়। তবে তা একেবারেই প্রাথমিক স্তরের আলোচনামাত্র। এ বিষয়ে এখনো কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব নয়। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ের নেতেৃত্বে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সহ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনে একপ্রকার মতৈক্য হয়েছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের মন্ত্রী যখন ঢাকায় এসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশ্বাস দিচ্ছেন, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হতে যাচ্ছে, তখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশ্বাস বা উদ্যোগগুলো রোহিঙ্গাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারছেনা। মিয়ানমার মন্ত্রীর ঢাকা সফর এবং কথিত প্রত্যাবাসনের আশ্বাসকে আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর কৌশল হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুরু থেকে নানা মহল থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের সৃষ্টি তাদেরকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মূল দাবী। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির সুপারিশেও এসব বিষয় উঠে এসেছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যুতে আনান কমিশনের রিপোর্ট, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আলোচনা এবং মহাসচিবের বক্তব্য এবং প্রস্তাব চীনের ভেটোর মধ্য দিয়ে ভেস্তে যাওয়ার পর গত সপ্তায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠকটিও কোন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়াই শেষ হয়ে যায়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রত্যাশিত রূপরেখা বাস্তবায়ন যখন একটি দীর্ঘমেয়াদী অনিশ্চয়তার চাঁদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল, তখন মিয়ানমার মন্ত্রীর ঢাকা সফর এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশ্বাসসহ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রæগ গঠনে মতৈক্য এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলা যায়। যদিও আন্তজার্তিক উদ্যোগগুলোকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে আলোচনা ও জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রæপ গঠনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ আছে। জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানের প্রয়োজনীয়তার কথা বাদ দিলেও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক স্টেকহোল্ডার চীনের মধ্যস্থতা বা তদারকি ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
অনেক সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই মানবিক অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছে। মিয়ানমার বাহিনীর নৃশংসতা ও এথনিক ক্লিনজিং অব্যহত রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথিত আশ্বাসে আশ্বস্ত হওয়া যায়না। কোফি আনান কমিশনের সুপারিশসমূহ মিয়ানমার সরকারও বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিল। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মধ্যস্থতাকারির ভূমিকা গ্রহণে ভারত রাজি না হলেও মিয়ানমার ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার এবং জাতিসংঘের অন্যতম স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান ও প্রত্যাবাসনে চীনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, নাগরিকত্ব এবং নিরাপত্তার ইস্যুতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য অংশিদার হিসেবে জাতিসংঘের দায়িত্ব গ্রহন এবং তত্ত¡াবধানের কোন বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির আগে রাখাইনে সেনাবাহিনী ও মগ দস্যুদের গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চলমান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উদ্যোগে মিয়ানমার সরকারের ইতিবাচক সাড়া হিসেবে বিবেচিত হলেও এ সম্পর্কে তাদের কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নেই। মিয়ানমার সরকার এখনো রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করছে। তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার কোন নীতিগত বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও গ্রহন করেনি। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখে তারা যদি আন্তর্জাতিক চাপ এড়ানোর কৌশল হিসেবে বাংলাদেশের সাথে যৌথ উদ্যোগের প্রস্তাব দিয়ে থাকে সেখানে ও সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপন্থা ও সময়সীমা থাকতে হবে। প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গারা যেন নতুন করে নির্যাতনের শিকার না হয়, এটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, চীনসহ অন্যান্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার শক্তিকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। রাখাইনে হাজার বছরের আদিবাসি রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যে বর্বর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ইতিমধ্যে আন্তজার্তিক গণআদালতে প্রমানীত হয়েছে। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে এ ধরনের গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের পুনরাবৃত্তি রোধ ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে আন্তর্জাতিক আদালতে এ ঘটনার বিচার হতে হবে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো ন্যায়সঙ্গত ভ‚মিকা নিলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
S. Anwar ৪ অক্টোবর, ২০১৭, ৯:৪৮ এএম says : 0
কেবলমাত্র দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগে রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপুর্ণ ও চিরস্থায়ী সমাধান কোনদিনও আসবে না। কারন বর্মী সরকার ও সেনা প্রশাসন মিথ্যাবাদী। এরা কখনো কথা দিয়ে কথা রাখবে না এবং বারে বারে এভাবে অসহায় রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে সর্বস্বান্ত করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিবে। সেই সাথে আমাদেরও দুঃখ বাড়াবে। তাই এই সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানের জন্য তৃতীয় পক্ষ হিসাবে জাতিসংঘকে অবশ্যই অবশ্যই সংযুক্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। এতে কোন সন্দেহ নাই।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন