ঢাকা নোংরা শহর, বস্তির শহর, যানজটের শহর, দূষণকবলিত শহর, অনিরাপদ শহর, বসবাসের অযোগ্য শহর, অসভ্য শহর- এ ধরনের নেতিবাচক অভিধা প্রতি বছরই কপালে জুটছে জনবহুল এই মেগাসিটির। এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এবারও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা, জরিপ ও সমীক্ষায় একই ধরনের চিত্র উঠে আসছে। ইকোনমিস্টের সেফ সিটি ইন্ডেক্সে ঢাকার অবস্থান একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। ৬০টি শহরের মধ্যে তার অবস্থান ৫৮। ইতিপূর্বে ঢাকা যে বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহরগুলোর একটি বলে কথিত হয়েছে সেই দুর্নামও বহাল আছে। নোংরা মানে কেবল ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ নয়, এর সঙ্গে বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ শব্দ দূষণ, শিল্প দূষণ ইত্যাদিও যুক্ত। এই সব দূষণের দিক দিয়েও ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। কেবল ঢাকাই নয়, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় শহর এবং সার্বিক বিবেচনায় গোটা বাংলাদেশ বিভিন্ন দূষণে নিমজ্জিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিশ্বের দূষণকবলিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বিশ্বে ছয়টি মৃত্যুর একটির জন্য দায়ী দূষণ। অথচ বাংলাদেশে দূষণের কারণে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যু হচ্ছে বায়ু, পানি ও মাটির দূষণে। এতেই বুঝা যায়, বাংলাদেশের অবস্থা কতটা ভয়াবহ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বিশ্বে ৯০ লাখ মানুষ মারা গেছে। ওই বছর এইডস, য²া, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গেছে, এই সংখ্যা তার তিনগুণের বেশি। মৃত্যুর অধিকাংশই হয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। চীন ও ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে; ৯০ লাখের প্রায় অর্ধেক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ বায়ু দূষণ, তার পরেই রয়েছে পানি দূষণ। বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রতিবেদনে দূষণের বিভিন্ন দিক ও মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য-বিবরণ নেই। না থাকলেও অনুমান করতে মোটেই কষ্ট হয় না। বাংলাদেশের বায়ু দূষণ ও পানি দূষণের ভয়াবহতার কথা তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অজানা নেই। বছর সাতেক আগে রাজধানীর বায়ু দূষণজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল। ওই গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ঢাকায় বায়ু দূষণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় বায়ু দূষণের নিত্য নতুন উৎস তৈরি হচ্ছে। পানি ও মাটি দূষণ ছাড়াও সড়কের ডিজিটাল বিলবোর্ড, ফটোকপির দোকান ইত্যাদি থেকে উদ্গত কণায় রাজধানীর পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, রাজধানীতে নিরাপদ পানি পাওয়া একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যা অন্যত্রও বিদ্যমান। দেশের প্রায় ৬ কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
দূষণ ও দূষণজনিত মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গী একমাত্র সোমালিয়া। এ কথা ভাবতেও অবাক লাগে যে, সোমালিয়ার মতো দারিদ্রপীড়িত ও সংঘাত-সংক্ষুদ্ধ দেশের পাশাপাশি অবস্থান হয়েছে তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারের দেশ বাংলাদেশের। সঙ্গতকারণেই সোমালিয়ার পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে, এতে কেউ বিস্মিত হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা এত শোচনীয় হবে কেন? প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি দশকের পর দশক ধরে সরকারের কর্মকান্ড এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় অবহেলিত থেকেছে। একথা অন্যান্য দেশের বেলায় যাই হোক, বাংলাদেশের বেলায় প্রায় ১০০ ভাগ প্রযোজ্য। রাজধানীর পরিবেশ দূষণ রোধে কত কথাই না বলা হয়েছে! অথচ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবনতি ছাড়া উন্নতি হয়নি। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, নদী দূষণ, মাটি দূষণ আরও বেড়েছে। প্রতিনিয়ত শিল্প ও পরিবহনের ক্ষতিকর ধুয়ায় বায়ু দূষিত হচ্ছে। শব্দ দূষণ রোধে যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নই এখন পর্যন্ত বন্ধ করা যায়নি। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলে মৃতপ্রায়, দূষণে জেরবার। মানববর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য প্রতিনিয়ত পড়ছে নদীগুলোতে। ঢাকার খালগুলো এখানো উদ্ধার করা হয়নি। অল্প বৃষ্টিতে এর রাস্তাঘাট ও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যায়। ড্রেনেজ সিস্টেম প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। পানি নামার জন্য আড়াই হাজার ক্যাচপিটের মধ্যে প্রায় এক হাজারই বন্ধ। পানি জট ও সেইসঙ্গে যানজটে নগরবাসী নাকাল হচ্ছে যখন তখন। অথচ নগর উন্নয়নে নানা ধরনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো কোনো সুফল দেয়নি। ঘোষিত ও বাস্তবানাধীন প্রকল্পগুলো এই নগরকে কতটা নিরাপদ ও বাসযোগ্য করতে পারবে তা নিয়েও সংশয়ের শেষ নেই। রাজধানীর যদি এই হাল, তবে দেশের অন্যান্য বড় শহরের অবস্থা কেমন বা ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
দেখা যাচ্ছে, রাজধানীই নয়, গোটা দেশই অনিরাপদ ও বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়ছে। দূষণ ও দূষণজনিত মৃত্যুর হার থেকে সেটাই উপলব্ধি করা যায়। এটা সত্য যে, সরকার এদিকে যথেষ্ট নজর দেয়নি বা দিচ্ছে না। উন্নয়নের বা যেসব পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে সেখানে এই বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এটা শুধু দুঃখজনই নয়, বরং অত্যন্ত উদ্বেগজনকও। সরকারকে দেশের পরিবেশ উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সকল প্রকার পরিবেশ দূষণ রোধে যথোপযুক্ত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের নাগরিকদেরও এ ব্যাপারে দায় রয়েছে। পরিবেশের ব্যাপারে তারা বেখেয়াল ও অসচেতন। তাদের অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতায় পরিবেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও অবনত হচ্ছে। নাগরিকদের এই মাইন্ডসেটের পরিবর্তন না হলে পরিবেশ সুরক্ষায় যত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপই নেয়া হোক না কেন, প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেনতা সৃষ্টি অপরিহার্য। সকল ক্ষেত্রেই আমাদের নাগরিক সচেতনতায় ঘাটতি রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকদের সিভিল সেন্সের যে পরিচয় পাওয়া যায় বা নাগরিক দায়িত্বশীলতা তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়, আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে তা প্রায় অনুপস্থিত। কাজেই নাগরিক শিক্ষার বিস্তার ও প্রসার ঘটাতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন