বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটা আছে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

একটি জাতীয় দৈনিকে ‘গরুর গাড়ির হেড লাইট’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় দেখে আমি মনোযোগের সঙ্গে পড়লাম। কারণ হেড লাইটের ‘হেড’ (Head) শব্দটির প্রতি আমার যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে ছাত্র জীবন থেকেই। কারণ ‘হেড’ (Head) হওয়ার মজাই আলাদা। যেমন, হেড মাস্টার (Head Master), , বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান ((Head of the Department) প্রভৃতি। নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মাস্টার মীর মোয়াজ্জেম আলী একটি বেত নিয়ে স্কুলের বারান্দা দিয়ে যখন এক পাশ থেকে আর এক পাশে হাঁটাহাঁটি করতেন তখন স্কুল মাঠে বা আনাচে-কানাচে দপ্তরি নিরোধকে পিছনে পিছনে হাঁটতে দেখা ছাড়া আর কাউকে দেখা যেত না। ক্লাস OFF থাকলেও সকলেই দৌড়ে ক্লাসরুমে চলে যেতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে Head of the Department যিনি ছিলেন তাকেই আমার নিকট শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে মনে হতো। ফলে তখন থেকেই ‘Head’ শব্দটির প্রতি আমার ঝোঁক শুরু। তবে তখন উপলব্ধি করতে পারিনি যে, গরুর গাড়িরও ‘হেডলাইট’ থাকতে পারে। হেড (Head) এর বাংলা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রধান’। ইংরেজিতে ক্ষেত্র বিশেষ যা আবার ‘Chief ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন Chief Justice, Army Chief, Chief Constable প্রভৃতি।
‘Chief’ হওয়ার পিছনে স্বাচ্ছন্দ যেমন আছে, তেমনি বিড়ম্বনাও কম নেই। যেমন, উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের নির্দেশ মোতাবেক রায় না দেয়ায় ৪ দিন পর সে দেশের প্রধান বিচারপতির লাশ একটি ড্রেনে পাওয়া যায়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধিপতি সুলতান সোলায়মানের বাল্যবন্ধু ও বিশ্বস্থ সেনাপতি ইব্রাহিমকে ঘুমের মধ্যে ফাঁসি দিয়ে দিলেন তিনি নিজেই। তবে বাংলাদেশের অবস্থা এখনো সে পর্যন্ত গড়ায়নি এ জন্য যে, যারা দন্ডমুন্ডের কর্তা তারা হয়তো দয়া করে মনে করেছেন যে, ইদি আমিন বা সুলতান সোলায়মানের মতো ঘটনা ঘটালে কথিত ‘আইনের শাসন’ বা ‘অবাধ গণতন্ত্রের’ উপরে যদি কালিমা পড়ে যায়। এটা আমার নিছক ধারণা, তবে তা কতটুকু গড়াবে তা এখনো আঁচ করা যাচ্ছে না।
কথাগুলি লিখছিলাম ষোড়শ সংশোধনী ও বিচারপতি এস কে সিনহার ঘটনাবলী নিয়ে। এস কে সিনহা যেদিন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তখন পরম্পরা মোতাবেক তার সম্বর্ধনা বক্তব্যে এটর্নি জেনারেল সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘বিচারপতি এস কে সিনহার প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথের মধ্যে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো।’ বিভিন্ন টক শোতে সরকারি ঘরনার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ যথা- মন্ত্রী, এমপি, শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী বিচারপতি সিনহার গুণ কীর্তনে মগ্ন ছিলেন তো বটেই, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা ও সাহসী সিদ্ধান্তের প্রতি জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো একটি মাত্র রায়ে, যে রায় দেয়ার পর বিচারপতি সিনহার ক্যান্সার ধারা পড়ার পূর্বেই প্রকাশ পেলো তিনি ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। তার অবৈধ কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের সন্ধানসহ মি. সিনহা হলেন সরকার ও সরকারি ঘরনার তুলোধুনোর সাবজেক্টমেটার। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন কি ছিলেন না, তিনি অবৈধ সম্পদের মালিক কি না বা তার ক্যান্সার হয়েছে কি হয়নি তা আজকে জাতির সামনে আলোচ্য বিষয় নয়। বিষয়টি হলো প্রধান বিচারপতি মি. সিনহার প্রতি সরকারের যে আচরণ দৃশ্যমান হলো তাতে কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো? ব্যক্তি সিনহা না বিচার বিভাগ?
বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হওয়া স্বত্তে¡ও একটি রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতিকে সরকার কর্তৃক এ ধরনের হেনস্তা হতে হবে কেন? এ হেনস্তার জন্য সরকারবিরোধী আইনজীবীরা সোচ্চার হলেও ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’ নিরব দর্শকের ভ‚মিকায়। অ্যাপিলেট ডিভিশনের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কর্তৃক সর্ব সম্মতিক্রমে গত ৩ জুলাই প্রদত্ত এক রায়ে সংবিধান মোতাবেক বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে যে মতামত ব্যক্ত করেছে, তা নিন্মে উল্লেখ করা হলো।
The independence of the judiciary is the foundation stone of the constitution and as contempated by article 22, it is one of the fundamental principles of State policy. The significance of an independent judiciary, free from the interference of other two organs of the government as embodied in article 22 has been emphasized in articles 94(4), 116A and 147 of the constitution. There has been a historic struggle by the people of this country for independence of judiciary, to uphold the supremacy of the constitution and to protect the citizens from violation of their fundamental rights and from exercise of arbitrary power.
সরকার অনির্বাচিত এটাই তাদের আতঙ্ক। শোনা যাচ্ছে যে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়েই ১৫৪ জন এমপিকে অবৈধ ঘোষণার বীজ বপন করা হয়েছিল। সে ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতি ১৫৪ জন এমপিকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন এমন আতঙ্কে প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে যে নাটকের সৃষ্টি হয়েছে তার যবনিকা টানতে সরকার কতটুকু কৌশলী হচ্ছে এটাই এখন দেখার বিষয়।
প্রধান বিচারপতি হয়তো একদিন মুখ খুলবেন। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেকেই মুখ খুলেছেন। সরকারি ঘরনার আইনজীবী ও হিন্দু কমিনিউটি নেতা রানাদাস গুপ্ত প্রধান বিচারপতির সাথে মন্দিরে সময় কাটিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, ‘মি. সিনহাকে অসুস্থ মনে হয়নি।’ ভারতীয় চ্যানেল জি-নাইন বলেছে, মাইনরিটি কমিউনিটি বলেই প্রধান বিচারপতিকে এভাবে হেনস্তা করা হলো। প্রথিতযশা আইনজীবী নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর নগ্ন হামলা।
প্রচার বা অপপ্রচার যাই হোক না কেন, সাধারণ জনগণ মনে করে যে, ছুটির দরখাস্তে মি. সিনহা স্বাক্ষর করেননি বা তাকে জোর করে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। সরকার বিষয়টির সত্যতা নিয়ে জনগণের মনে আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ছুটির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জাতিকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। তবে ইতোমধ্যে আরো নাটক বা ঘটনা/অঘটনা মঞ্চস্থ হয় কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্ব ও পরে প্রধান বিচারপতি তো বটেই কোনো বিচারপতিকেও এ ধরনের অসস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তার অনেক সিদ্ধান্তে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়েছে, দুদক ও পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে, লাভবান হয়েছে সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত বিরোধী দল। তার প্রভাবে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১ক ধারায় প্রদত্ত হাইকোর্টের ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে, অ্যান্টিসিপেটরি জামিনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, হাইকোর্টের দেয়া প্রথিতযশা রাজনীতিবিদদের জামিন স্থগিত হয়েছে। সবকিছুতেই তিনি প্রভাব বিস্তার করেছেন বলে বলা হয়ে থাকে। তারপরও মি. সিনহার প্রতি সরকারের এ ক্ষোভ অনেক অর্থ বহন করে যা মোটাদাগে উপলব্ধি করার কথা নয়।
সরকারের বক্তব্যে মনে হয় যে, দেশে এখন স্বর্ণযুগ চলছে। যদিও চালের দাম প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকা, কাঁচামরিচ কেজি প্রতি ২০০ টাকা, গরুর মাংস ৫০০-৫৫০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্য তো বাড়ছেই। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ভ‚মিদস্যুরা সরকারি দলের লোক। ভ‚মি দস্যুতা ও ব্যাংক লুটে সরকারি দল সর্ব সময়ের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পুলিশ লেলিয়ে বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় ৫ জন লোক একত্রিত হলেও নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে। সংবিধান মোতাবেক জনগণের সভা সমাবেশ, মুক্তচিন্তা করার যে অধিকার ছিল, তা শুধু সংবিধান নামক বইতে পাওয়া যাবে, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। মৌলিক অধিকারের কথা জনগণ ভুলতে বসেছে। এ অবস্থার পরও সরকারের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, বিচারবিভাগের স্বাধীনতার বয়ান দেশে-বিদেশে চলছে তো চলছেই। বয়ানের গতি দেখে মনে হয় সরকার যেন একটা রানিং (চলন্ত) ট্রেন, চলছে তো চলছেই, থামবার কোনো লক্ষণ নেই। সরকারকে যদি চলন্ত ট্রেন মনে করি তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে বিচার বিশ্লেষণ করবো কীভাবে?
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন