অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষ হলো। চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হলো অনেক প্রত্যাশিত মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভার। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার পর ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন তিনি। উদ্বোধনের পরপর যানবাহন চলাচলের জন্য ফ্লাইওভারটি খুলে দেয়া হয়। এর আগে উদ্বোধনের জন্য ফ্লাইওবারটি রঙিন সাজে সাজানো হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধানে নির্মিত ফ্লাইওভারটির নাম মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার হলেও এটি একটি বহুমুখী ফ্লাইওভার। তিনটি ভাগে এর নির্মাণকাজ করা হয়। প্রথমাংশ তেজগাঁও-সাতরাস্তা থেকে মগবাজার মোড় হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। এ অংশটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৫৫৫ কিলোমিটার। এই অংশটি ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফ্লাইওভারটির উদ্বোধন করেছিলেন। এর সঙ্গে এফডিসি থেকে সোনারগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত বর্ধিতাংশ রয়েছে। এটি যান চলাচলের জন্য চলতি বছরের ১৭ মে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফ্লাইওভারটির দ্বিতীয় অংশ বাংলামোটর থেকে মগবাজার মোড় হয়ে মৌচাক পর্যন্ত। এর দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ২০৮ কিলোমিটার। এই অংশটি যান চলাচলের জন্য গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তৃতীয় অংশটি হচ্ছে শান্তিনগর-রাজারবাগ-মালিবাগ-রামপুরা। এ অংশটির দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৯৩৭ কিলোমিটার। গতকাল বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন। এ উদ্বোধনের মাধ্যমে পুরো ফ্লাইওভারটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। চার লেনের এ ফ্লাইওভারে ওঠানামার জন্য ১৫টি র্যাম্প রয়েছে। তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, বিএফডিসি, মগবাজার, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, বাংলামোটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং শান্তিনগর মোড়ে ওঠানামা করার ব্যবস্থা রয়েছে। দুপুরে মৌচাক মোড়ে প্যান্ডেল তৈরি করে ডিজিটাল বোর্ডের মাধ্যমে এ ফ্লাইওভারের উদ্বোধন দেখানো হয়েছে। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আর মৌচাকে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এমপি ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্যানেল মেয়র মো: ওসমান গনিসহ আওয়ামী লীগের নেতা ও দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।
উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ফ্লাইওভারকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক উল্লেখ করে বলেন, গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, এতে কিন্তু জ্যামও বাড়ছে। এ কারণেই জনগণের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। মানুষ দ্রুত কর্মস্থলে পৌঁছতে পারবে। কর্মচঞ্চলতা বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় আমি খেয়াল রেখেছি, কয়েকবার ডিজাইন চেঞ্জ করেছি।
২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ৮ দশমিক ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ তিন তলাবিশিষ্ট চার লেনের এই ফ্লাইওভারটি ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। এর নিচে বিভিন্ন জায়গায় আটটি বড় মোড় ও তিনটি রেলক্রসিং রয়েছে। ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ হাজার ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করেছে এলজিইডি। এর প্রতি মিটারে খরচ হয়েছে ১৩ লাখ টাকা।
এদিকে, নতুন এই ফ্লাইওভার উদ্বোধন হওয়ার পর মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরা, মৌচাক এলাকায় গতকাল থেকে আনন্দ- উৎসব চলছে। শত শত মানুষ আসছে নতুন ফ্লাইওভার দেখতে। শুধু ফ্লাইওভার নয়, এর নিচের রাস্তা দেখতেও মানুষ আসছে। মৌচাক থেকে মালিবাগ হয়ে রামপুরা পর্যন্ত রাস্তাটি এখন ঝকঝকে। তবে রামপুরা আবুল হোটেল সংলগ্ন এলাকায় কিছু অংশ রাস্তা ওয়াসার ড্রেনেজ লাইনের কারণে এখনও সংস্কারকাজ চলছে। সব মিলিয়ে ওপরে-নিচে উৎসুক মানুষের ভিড়। রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকাজুড়ে নির্মিত এই ফ্লাইওভার নির্মাণে এলজিইডির কোনো গাফিলতি ছিল না। তবে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে গাফিলতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী শ্যামা প্রসাদ অধিকারী ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করেছেন। তার তত্ত্বাবধানের ফসল দেরিতে হলেও আলোর মুখ দেখল। ফ্লাইওভারটি চালু হলে যানবাহন চলাচলের বাধা যেমন কাটবে, তেমনি যানজটের ভোগান্তিও কমবে। একই সাথে ফ্লাইওভার এলাকার কয়েক লাখ মানুষের দুর্ভোগ ঘুচবে। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে যারা ঘর থেকে বেরুতে বা ঘরে ফিরতে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন তারা গতকাল থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। এ ছাড়া ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও ধস নেমেছিল। সেই সব প্রতিষ্ঠান আবার প্রাণ ফিরে পেতে যাচ্ছে। জমে উঠছে মার্কেট-বিপণি বিতান। মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বলেন, ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরুর পর থেকে প্রথম দিকে ধুলা-বালুতে দোকান খোলা যেত না। এরপর খোঁড়াখুঁড়িতে পুরো দোকানই বন্ধ রাখতে হয়েছে। দীর্ঘদিন রাস্তা সংস্কার না করায় অনেক দোকান সেই ২-৩ বছর ধরেই বন্ধ। যেগুলো খোলা যেত সেগুলোতে কোনো কাস্টমার আসত না। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিয়েছেন। ফ্লাইওভার এবং এর নিচের রাস্তা সংস্কার হওয়ার সাথে সাথে পুরো এলাকার চিত্র পাল্টে গেছে জানিয়ে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, মালিবাগ-মৌচাক এলাকার মার্কেটগুলো আবার জমে উঠতে শুরু করেছে। যানজট না থাকায় এই এলাকা দিন দিন আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা নির্মাণ করেছে এলজিইডি। তবে ড্রেন নির্মাণ করছে সিটি কর্পোরেশন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন