এম বেলাল উদ্দিন, রাউজান (চট্টগ্রাম) থেকে
চট্টগ্রামের রাউজানের দক্ষিণ নোয়াপাড়ার রেজাউল করিমের বিয়ের ৬ বছর পর ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিল শিশু সন্তান আয়শা করিম সামিয়া। তাকে পেয়ে পরিবারে আনন্দ ভরে যায়। তবে সে আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে গত ১ মার্চ মাত্র দুই বছর বয়সে পুকুরে ডুবে মারা গেল সামিয়া। সামিয়ার নানা মোহাম্মদ আলী অশ্রু সজল কণ্ঠে বলেন, নাতনিতো মারা গেছে এখন তার শোকে আমার মেয়েকে বাঁচানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। মেয়ের শোকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বারবার শুধু আহাজারি করে জ্ঞান হারাচ্ছে। একই ইউনিয়নের ছামিদর কোয়ং গ্রামের তেঁতুলতলা বাড়ির তৈয়ব আলীর একমাত্র শিশু সন্তান ছিল তিন বছর বয়সী তাওহিদুল ইসলাম তানভীর। গত বছরের ১৩ জুলাই বেলা ১টার দিকে এ শিশুটি বাড়ির সামনের পুকুরে পড়ে মারা যায়। নিহত শিশুর পিতা তৈয়ব আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার একমাত্র সন্তান কলিজার টুকরাটা এভাবে চলে যাবে কল্পনাও করিনি। আমার সবশেষ হয়ে গেছে। আমার আদরের ছেলেটা অনেক সুন্দর করে কথা বলতো। আমি তাকে ছাড়া কি করে বেঁচে থাকবো। একমাত্র ছেলে সন্তানকে হারিয়ে তার মা আয়শা আকতারও বারবার জ্ঞান হারিয়েছেন। এ মা-বাবার পুত্র শোকের কান্না এখনও থামেনি। এ চিত্র শুধু উপজেলার নোয়াপাড়া নয়, রাউজানের বহু পরিবারে এখন এমনই চিত্র। উপজেলায় একের পর এক পুকুরে ডুবে মারা যাচ্ছে শিশু। গত প্রায় ১১ মাসে রাউজানে কমপক্ষে ১৮-২০ জন শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে এ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মারা গেছে তিন শিশু। যাদের অনেকেই আছে বহু সাধনার পর কোলজুড়ে আসা মা-বাবার একমাত্র সন্তান। কিন্তু সে সন্তানকে আগলে ধরে রাখা যেন মা-বাবা ও স্বজনদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কেন, কি কারণে মা-বাবা কিংবা স্বজনেদর এই চেতনার অভাব? এত প্রত্যাশার পর যে শিশু জন্মের পর মা-বাবার মুখ আলোয় ভরে গেছে, সে শিশু সন্তান কেন হঠাৎ করে পুকুরে ডুবে মারা যাচ্ছে? কেন মা-বাবার হৃদয়ে সন্তান হারানোর পাথর বুকে বসছে? এমন প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে সচেতন মহলের মাঝে। তবে বিজ্ঞ মহলের একমাত্র ধারণা, স্বজনদের অসচেতনার কারণেই শিশুদের এই পরিণতি হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে জানা গছে গত ২০১৫ সালের মে মাস থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় কমপক্ষে ১৮-২০ শিশু পুকুরে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে। এ প্রসঙ্গে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফজল করিম বাবুল বলেন, শিশু পুকুরে পড়ার পর পানি খাওয়ার উপর নির্ভর করে তার মৃত্যু। বয়সভেদে কোন শিশু ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে মারা যায়। আবার কেউ কেউ আধঘণ্টাও বেঁচে থাকে। তবে তা নির্ভর করছে পানিতে হাত-পা নাড়াচাড়ার উপর। যেসব শিশু পুকুরে পড়ার হাত-পা নাড়ে, সেসব শিশু আধাঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। যে শিশু একেবারে কম বয়সী সেসব শিশু ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে মারা যায়। তবে পানি বেশি খেলে তার আগেও মারা যায়। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন বাচ্চাদের প্রতি কম সময় দেয়া, খেয়াল না রেখে সামাজিক কাজে বেশি সময় ব্যয় করাসহ নানা কারণে এ ধরনের মৃত্যুর হার বাড়ছে। এটা রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। গহিরা কলেজের অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বলেন, পিতা-মাতা অসাবধানতা, আজকাল সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিঙ্গেল পরিবারের কারণে বাচ্চার দেখাশোনার মানুষ কম। এ কারণে বাচ্চা খেলতে গিয়ে পুকুরে পড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বাচ্চাদের পানির প্রতি ঝোঁক বেশি থাকে। একসময় মা-বাবারা শিশুদের কোমরে একধরনের বাজনা (ঝুনঝুনি) বেঁধে দিত। সে ঝুনঝুনির শব্দে বাচ্চা কোনদিকে যাচ্ছে তা মা-বাবা জানতো। সেই যুগ আর নেই। তবে সেই যুগের পরিবর্তন হলেও ঝুনঝুনির বিকল্প কোনকিছুও এখন নেই। এটিও একটি কারণ শিশুর পুকুরে ডুবে মৃত্যুর জন্য। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্বজনদের সচেতনতা। এ প্রসঙ্গে রাউজান ইমাম কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ও হযরত নাতোয়ান শাহ (রহ.) জামে মসজিদের খতিব এস এম খালেদ আনছারী বলেন, শিশুর প্রতি দয়ামায়া, ধর্মীয় মূল্যবোধ কমেছে সমাজে। ব্যাপক জনসচেতনতাই পারে শিশুর পুকুরে ডুবে মৃত্যুর হার কমাতে। পাড়ায় পাড়ায় মৃত্যু নিয়ে সভা, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এ প্রসঙ্গে লিফলেট বিতরণসহ সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে হয়তো এ মৃত্যুর হার কমতে পারে। এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কুল প্রদীপ চাকমা বলেন, প্রত্যেক মা-বাবার দায়িত্ব তার ছেলেমেয়েদের দেখে রাখা। অনেক সময় মা বাবার অবহেলায় শিশু পুকুরে পড়ে যায়। এই মৃত্যুর হার কমানোর জন্য প্রত্যেক মা-বাবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ১৩ জুলাই নোয়াপাড়া ছমিদার কোয়াং এলাকার মারা যায় মোহাম্মদ তৈয়ব আলীর পুত্র তিন বছর বয়সী তাওহীদুল ইসলাম তানভীর। গত বছরের ২ নভেম্বর সকাল ১০টায় বাগোয়ানের পাঁচখাইন গ্রামের আমিন উল্লাহ ডাক্তারের বাড়িতে পুকুরে পড়ে মারা যায় প্রবাসী মনসুর আলমের শিশুকন্যা হুমায়রা। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর নোয়াপাড়ার শেখপাড়া গ্রামের জান বক্স সারাংয়ের বাড়িতে পুকুরে পড়ে মারা যায় সবজি ব্যবসায়ী আবছারের ছেলে স্কুলছাত্র আসিফ। ওই বছরের ১৮ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের কচুখাইন গ্রামের মুহাম্মদীয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার উত্তর পাশে দিনমজুর সোলেমানের কন্যা পূর্ব কচুখাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণীর ছাত্রী শিমু আকতার (৮) বাড়ির পাশের পুকুরে গোসল নেমে ডুবে মারা যায়। ওই বছরের ১৫ অক্টোবর দুপুর ১২টায় পুকুরে পড়ে মারা যায় হলদিয়া ইউয়িনের কারিগর বাড়ির প্রবাসী মোহাম্মদ জানে আলমের শিশুকন্যা ছায়েবা (৩)। ওই বছরের ১ জুন রাউজান পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের সুলতানপুর কাজীপাড়ায় পুকুরে ডুবে মারা যায় আহম্মদ তালুকদারের বাড়ির মো. শফির কন্যা শিশু পুষ্পিতা। ওই বছরের ১৮ মে পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের পূর্ব গুজরা গ্রামে আজগর আলী সিকদার বাড়িতে মারা যায় সেলিম উদ্দিনের ছেলে আশিকুর রহমান। ওই বছরের ৭ মে বেলা ১১টার দিকে মারা যায় নোয়াপাড়া পথেরহাটের পূর্ব পাশে শীলপাড়া এলাকার টিপু শীলের কন্যা দেড় বছর বয়সী বৃষ্টি শীল। ওই বছরের ১১ মে পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের ডিআইবি আহমদ হোসেনের বড়িতে নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পুকুরে পড়ে মারা যায় একই ইউনিয়নের মো. জাবেরের কন্যা দশ বছর বয়সী শিশুকন্যা মীম। ওই বছরের ১৮ জুলাই নোয়াপাড়া ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামে পুকুরে ডুবে উম্মে হুমায়রা জিতু (১৩) নামের ২ শিশু কন্যার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। জিতু নোয়াপাড়া শেখপাড়া প্রাইমারি স্কুলের ৩য় শ্রেণী ও একই স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল মিনহা। ওই বছরের ২০ জুন বাগোয়ান ইউনিয়নের গশ্চি স্কুলের পাশের ইদ্রিস মেম্বারের বাড়িতে পুকুরে ডুবে মারা যায় ৬ বছরের শিশু কন্যা মাহিয়া। একইদিন পৌরসভার নন্দীপাড়ায় মারা যায় চন্দন দাশ ও লাকী দাশের সাত বছর বয়সী ছেলে নিলয় দাশ। ওই বছরের ১৬ জুলাই দুপুর সাড়ে বারটার দিকে বাগোয়ান ইউনিয়নের গশ্চি ধরের টেক এলাকার আজম খানের একমাত্র পুত্র সন্তান মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন (১৩) নামের শিশু কর্ণফুলী নদীতে ডুবে মারা যায়। ওই বছরের ৫ জুলাই পশ্চিমগুজরা ইউনিয়নের উত্তরগুজরা রুপচান্দ নগর মোনা মুন্সির বাড়িতে পুকুরে পড়ে মারা যায় ওমান প্রবাসী মোহাম্মদ মহরম আলী ও নাছিমা আকতার কলির একমাত্র ২ বছরের শিশুকন্য জান্নাতুল মাওয়া নিহা। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব গুজরা আধারমানিক নতুন বাজারে প্রতাপ চৌধুরী বাড়ির বাবলু চৌধুরীর ছেলে অর্ক চৌধুরী নামের দেড় বছরের এক শিশু পুকুরে ডুবে মারা যায়। চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে পূর্ব গুজরা বড় ঠাকুরপাড়া মনা বৈদ্যের বাড়িতে তপন বৈদ্যের ছেলে পান্থ দে নামের দেড় বছর বয়সী শিশু মারা যায়। চলতি মাসের ১ মার্চ দক্ষিণ নোয়াপাড়ায় রেজাউল করিমের দুই বছর বয়সী কন্যা সামিয়া পুকুরে ডুবে মারা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন