শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

লক্ষ্মীপুরে অপহরণের ঘটনা বৃদ্ধিতে জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্ক ‘ক্ষমতার দাপটে তারা এসব করছে’

প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এস এম বাবুল (বাবর), লক্ষ্মীপুর থেকে
লক্ষ্মীপুরে অপহরণের ঘটনা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। চলিত বছরের প্রথম থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জেলার সদর উপজেলা, চন্দ্রগঞ্জ, রায়পুর, রামগঞ্জ ও রামগতি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে শিশু, ছাত্র-ছাত্রী, ব্যাংক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, শ্রমিক সহ ২০জনকে অপহরণ করা হয়। এসব অপহরণের ঘটনায় জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টায় এ যাবৎ অপহৃত ১৭ জনকে উদ্ধার করা হলেও অপহরণের পর ২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এখনও রামগঞ্জ মডেল কলেজের একাদশ ছাত্রী ফারহানা রহমান (সায়েমা) নামের এক ছাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। গত ৪ মার্চ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কালীবাজারের মোবাইল ব্যবসায়ী রাজিব হোসেনকে অপহরণ করা হয়। অপহৃত রাজিব হোসেনের মা পারভীন আক্তার ও স্থানীয়রা জানান, গত শুক্রবার বিকেলে মোবাইল ফোনে রাজিব হোসেনকে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে কে বা কারা অপহরণ করে। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু করায় অপহরণকারীরা তাকে কালীবাজারের পার্শ্বে খালপাড় এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রেখে পালিয়ে যায়। গত ৭ মার্চ রাতে সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের দক্ষিণ দুর্গাপুর গ্রামের রহমানিয়া তালিমুল কুরআন কাওমি মাদরাসা থেকে রবিউল ইসলাম (১১), মনিরুল ইসলাম (১০), মোঃ রাসেল (৮), মোঃ আবদুল্লাহ (১০), সোহরাব হোসেন (৯) ও মোঃ মুরাদ হোসেন (১২)সহ ৬ শিক্ষার্থীকে নিয়ে ঐ মাদ্রাসার শিক্ষক হোসাইন অপহরণ করে নিয়ে যায়। ঘটনার একদিন পর চাঁদপুরের মতলব এলাকা থেকে পুলিশ অভিযুক্ত শিক্ষক হোসাইন ওরফে জসিমকে আটক করে এবং ছয় ছাত্রকে উদ্ধার কারে। গত ২ মার্চ রায়পুর উপজেলায় পূবালী ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে অপহরণ করে মোবাইল ফোনে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। এ ঘটনায় অপহৃতের স্ত্রী খাদিজা বেগম পান্না রায়পুর থানায় উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন জুয়েল, পৌরসভার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আনোয়ার হোসেনসহ তিন জনকে আসামি করে একটি অপহরণ মামলা করেছে। ঘটনার একদিন পর রায়পুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ লোকমান হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ অভিযান চালিয়ে উপজেলার নতুন বাজার এলাকা থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা জিল্লুর রহমানকে উদ্ধার করে এবং ঘটনার সাথে জড়িত স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারী চন্দ্রগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী এক ছাত্রীকে অপহরণর করা হয়। সে চন্দ্রগঞ্জের আমানী লক্ষ্মীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। এ ঘটনায় অপহৃতার ফুফাতো ভাই মো. রাকিব হোসেন বাদী হয়ে আক্তার হোসেন শান্ত নামে এক যুবকসহ ৬-৭ জনের বিরুদ্ধে চন্দ্রগঞ্জ থানায় মামলা করেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারী লক্ষ্মীপুর শহরের একটি ভাড়া বাসা থেকে সুবর্ণা আক্তার (১০) ও স্বর্ণা আক্তার (৮) নিখোঁজ হয়। এ বিষয়ে তাদের মা শাহিনুর আক্তার লক্ষ্মীপুর থানায় সাধারণ ডায়রী করেন। ঘটনার একদিন পর পুলিশ শহরের বাঞ্ছানগরের একটি বাসা থেকে তাদের উদ্ধার করেছে ঐ সময় একজনকে গ্রেফতার করা হয়। গত ২৯ ফেব্রুয়ারী সদর উপজেলার চরচামিতা এলাকা থেকে বেগম অজিফা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী রোকসানা আক্তারকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে অপহরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। অপহৃত স্কুল ছাত্রী উপজেলার মটবী গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের মেয়ে। প্রতিদিনের ন্যায় রোকসানা নিজ বাড়ি থেকে তার সহপাঠীদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে স্কুলের কাছাকাছি চরচামিতার রাইসমিল এলাকায় পৌঁছলে মাইক্রোযোগে একদল সন্ত্রাসী জোরপূর্বক রোকসানা আক্তারকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। গত ৮ ফেব্রুয়ারী লক্ষ্মীপুর হলিগার্লস স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে স্কুল থেকে বাড়ি পেরার পথে লাহারকান্দী এলাকা থেকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের ৫ দিন পর পুলিশ অপহৃত ছাত্রীকে উদ্ধার করে এবং রুবেল ও সুমন নামে দুইজনকে গ্রেফতার করে। গত ২৬ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুর শহরের রেহান উদ্দিন ভূইঁয়া সড়কের সাজিদ মঞ্জিল নামে একটি ভবনের নির্মাণ শ্রমিক আবুল কালাম নিখোঁজ হয়। ৬ দিন পর শহরের রহমতখালী খাল সংলগ্ন রেহানউদ্দিন ভূইয়া ঈদগাঁ এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত আবুল কালাম সদর উপজেলার চররুহিতা গ্রামের মৃত মোবারক আলীর ছেলে। গত ২২ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুর শহরের একটি প্রাইভেট হাসপাতালের সামনে থেকে কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন এলাকার আবদুল আওয়ালের ছেলে আবদুর জাহের রাশেদকে অপহরণ করে বিকাশ নাম্বারের মাধ্যমে মুক্তিপন আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়। বিকাশ নাম্বারের সূত্র ধরে লক্ষ্মীপুর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক এসআই পলয় রায় ও সহকারী উপ-পরিদর্শক এএসআই রেজাউল করিম রেজাসহ ডিবি পুলিশের একটি দল অভিযান চালিয়ে ঐদিন সন্ধ্যায় আবিরনগর এলাকা থেকে আবদুল্লাহ আল মামুন ও মোঃ সুজন নামের দুই অপহরণকারীকে আটক করে। গত ১৭ জানুয়ারি রামগঞ্জ মডেল কলেজের একাদশ ১ম বর্ষের ছাত্রী ফারহানা রহমান (সায়েমা) বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়। গত ১৯ জানুয়ারি তার মা নাজমুন নাহার বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখসহ আটজনের নামে রামগঞ্জ থানায় অপহরণ মামলা করেন। গত ১৭ জানুয়ারি সকালে বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার পথে রিয়াদ হোসেনও তার সঙ্গীয় লোকজন সায়েমাকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। ঘটনার দুইদিন পর থানায় মামলা করলেও আজর তাকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। গত ১৪ জানুয়ারি চন্দ্রগঞ্জ থানার কামারহাট এলাকার তিন রাস্তার মোড় থেকে চরশাহী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের একমাস পর স্কুলছাত্রী সোনিয়া আক্তারকে (ছদ্মনাম) মাগুরা জেলা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ এবং মনির হোসেন নামের এক জনকে গ্রেফতার করা হয়। গত ৫ জানুয়ারি রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের উদমারা গ্রামের সিরাজ সরদারের ছেলে জলিল সরদার (৩০) নিখোঁজ হয়। ১ দিন পর ঐ গ্রামের ধান ক্ষেতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। গত ১ জানুয়ারি রামগতি উপজেলার শিক্ষা গ্রাম থেকে জান্নাতুল ইসলাম জেনিয়া (৭) কে অপহরণ করা হয়। অপহৃত জান্নাতুল ইসলাম জেনিয়া স্থানীয় কচিকণ্ঠ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ১ম শ্রেণীর ছাত্রী এবং আলেকজন্ডার শিক্ষা গ্রামের মো: আবদুল অদুদের মেয়ে। অপহরণের ২৪ ঘণ্টা পর রামগতি উপজেলার চরলক্ষ্মী এলাকা থেকে ওই স্কুল ছাত্রীকে উদ্ধার এবং অপহরণের সাথে জড়িত ফাতেমা বেগম নামের এক মহিলাকে স্থানীয় জনতা আটক করে। গত ১ জানুয়ারি চন্দ্রগঞ্জ থানার দেওপাড়া গ্রামের সৌদি ফেরত যুবক নূরে আলম প্রেমিকা বৃষ্টি ওরফে সুমীর (১৮) সাথে লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর তেমুহনীতে দেখা করতে গেলে প্রেমিকা বৃষ্টি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে সিএনজিযোগে নূরে আলমকে মজুচৌধুরীর হাটে নিয়ে গেলে বৃষ্টির অন্য সহযোগীরা মিলে নূরে আলমকে মজুচৌধুরীর হাটের একটি ফিসারীর ভিতরে গোপন কক্ষে আটক করে তার পরিবারের কাছে ৬ লক্ষ টাকা দাবি করে। অপহরণকারীদের দেয়া একটি বিকাশ নাম্বারে ২০ হাজার টাকা পাঠায় নূরে আলমের পরিবার। এরই সূত্রধরে গত ৩ জানুয়ারি চন্দ্রগঞ্জ থানা পুলিশ মজুচৌধুরীর হাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে অপহরণের ৩ দিন পর প্রবাসীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পুলিশ সদর উপজেলার চর আলী হোসেন এলাকার রুবেল ও জহির নামের দুজনকে আটক করেছে। উল্লেখ্য, একদিকে জেলার সর্বত্র অপহরণের আতঙ্ক, অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গত আড়াই মাসের অপহরণ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয় হলেও জেলার সর্বত্র অপরাধ কমছে না। কারণ হিসেবে সাধারণ মানুষ মনে করছেন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে অবাধে অপরাধ করে চলছে। পুলিশ প্রশাসন কখনো এসব রাজনৈতিক অপরাধীদের ধমন করছে কখনো ধমনে ব্যর্থ হচ্ছে। যার কারণে অপহরণ নাটক কমছে না, বাড়ছে। একজন অপহরণের শিকার ব্যক্তির স্বজনরা জানান, অপরাধীরা কোন পেশাধার নয়, এরা রাজনৈতিক দলের সদস্য, ক্ষমতার দাপটে তারা এসব করছে। ভুক্তভোগীরা দাবী করছেন নতুন পুলিশ সুপার এসব অপরাধগুলো দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন