বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

মনের কষ্টে কৃষক ক্ষেতের আলু খাওয়াচ্ছেন গরু-ছাগলকে

প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নজির হোসেন নজু, সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে
কৃষকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়েও দাম পাচ্ছেন না। একের পর এক ফসলের দামে মার খাচ্ছেন। প্রতিবছর এ অবস্থায় এবার আলু চাষ করেও দামে মার খেয়ে চরম লোকসানের মুখে পড়েছেন। ফলে এই এলাকার কৃষকরা বোরো আবাদেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের কৃষকদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে এরকম যে, যে ডাল ধরছে সেই ডালই ভেঙে পড়ছে। অর্থাৎ একের পর এক ফসল আবাদ করছেন কিন্তু দাম পাচ্ছেন না। আমন আবাদ করে বাম্পার ফলন ঘরে তোলার পরেও বাজারে দাম নেই। এক মণ ধান বেচে কৃষক ১ কেজি গরুর মাংস কিনতে পারছেন না। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ ধান (৬০ কেজি) ৩৩০ থেকে ৩৪০ টাকা আর গরুর মাংস প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এই লোকসান পুষিয়ে নিতে এখানকার কৃষকরা বিস্তীর্ণ জমিতে আলুর আবাদ করেন। বীজ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরিসহ নানা খরচে আলুর উৎপাদনে কৃষকরা খুশি হলেও দামে কৃষকের হাসি ম্লান হয়ে পড়েছে। এ বছর প্রচ- কুয়াশার কারণে বার বার ছত্রাকনাশক ও অন্যান্য ওষুধ স্প্রে করায় আলু উৎপাদনে খরচ বেড়ে যায়। এ ছাড়া একজন পুরুষ কামলা ২৫০ টাকা ও নারীর ক্ষেত্রে ১৫০ টাকা গুনতে হয়েছে। এসব নানা কারণে এবারের আলু উৎপাদনে তুলনামূলকভাবে খরচ বেড়েছে। বোরো লাগানোর জন্য আলুর জমি খালি করতে হবে। তাই নারী-পুরুষ কামলা লাগিয়ে কৃষকরা ক্ষেতের আলু তুলছেন। ইষ্টিক, গ্রানুলা, ডায়মন্ড প্রভৃতি জাতের এসব আলু তোলা হলেও মোটেই দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। এক বস্তা আলু (৮৫ থেকে ৯০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৭০০ টাকায়। তাই পাইকাররা ক্ষেতেই কৃষকের আলু কিনছেন। উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নে দলুয়া এলাকার কৃষক আমিমুল রেহসান জানান, তার ৫ বিঘা জমিতে আলু লাগানো থেকে ওঠা পর্যন্ত যে খরচ হয়েছে তার অর্ধেক খরচও উঠবে না। কৃষকদের কেউ দেখেন না বলে আক্ষেপ করেন। একই এলাকার আমিনুল ইসলাম জানান, এখানকার কিছু কিছু কৃষক দামের কারণে রাগে ও ক্ষোভে ক্ষেতের আলু গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, কৃষকরা পুঁজি হারানো ঘাটতি মোকাবিলার জন্য প্রতিবছর ৩-৫ কাঠা জমি বিক্রি করে সাংসারিক প্রয়োজনীয় খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে কৃষকের জমির পরিমাণ কমে আসছে। অপরদিকে পরিবারে লোকসংখ্যা বাড়ায় হিমশিম খাচ্ছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হোমায়রা ম-ল জানান, প্রতিবছর ফসল উৎপাদন করে কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়ছেন। আলুর দাম কম হওয়ায় এখানকার ৩টি হিমাগার আলু সংকটে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, জমি যেহেতু আছে, সেজন্য আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে কৃষকদের উৎপাদনে কম খরচ হবে এবং ফলনে লাভবান হবেন তারা।
কুড়িয়ে ও খুঁড়িয়ে ওদের সুখ
ওরা গরিব ও অভাবী পরিবারের সন্তান। সবার বয়স ২ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে। কেউ স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ে। আবার কেউবা প্রতিষ্ঠানের চৌকাঠ পেরোয়নি। তারা কৃষকের ক্ষেতের ছেড়ে যাওয়া আলু কুড়িয়ে ও খুঁড়িয়ে সংগ্রহ করে আর হালের পেছনে পেছনে কুড়িয়ে নিজের সুখ অনুভব করে। আসমা, রুমন, আকাশ, জয়া, শেফালি এসব কচি মুখের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, বাড়িতে সারা বছরের জন্য যে আলু লাগে তা এভাবে সংগ্রহ করে মায়ের কাছে দেবেন। মায়েরা এসব আলু হাঁড়ি-পাতিল বা বালুতে সংরক্ষণ করবেন নিজস্ব পদ্ধতিতে। প্রয়োজনে আলু ভর্তা, ডাল, আলুর রুটি-পরোটা, পাপড় ইত্যাদি তৈরি করে এবং তরিতরকারিতে ব্যবহার করে অভাবের সময়টা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কৃষকরা সাধারণত ক্ষেতের আলু কামলা দিয়ে তুলে থাকেন। আলু তোলার সময় অসতর্কতার কারণে কিছু কিছু আলু মাটিতে চাপা পড়ে যায়। এদের মূল টার্গেট হলো এসব আলু সংগ্রহ করা। আগে এসব গরিব ও অভাবী পরিবারের ছেলেমেয়েরা ক্ষেতে প্রবেশ করতে পারে না। কৃষকরা আলু নিয়ে যাওয়ার পর জমি তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তারা বাশিলা, কোদাল ইত্যাদি দিয়ে মাটি খুঁড়িয়ে মাটির ভেতর লুকিয়ে থাকা আলু বের করে আনেন এবং কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে রাখেন। এ ছাড়া অন্য ফসল আবাদের জন্য আলুর জমি চাষ করার সময় হালের পেছনে পেছনে ছোটেন। এতে মাটিতে লুকিয়ে থাকা আলু বাইরে বেরিয়ে আসে। মহাআনন্দে এসব আলু তারা দলবেঁধে কুড়িয়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে জমির মালিকের বকাঝকাও তাদের কপালে জোটে। যাদের জমিজমা নেই, কেনার সামর্থ্যও নেই তাদের পরিবারের সন্তানরা মূলত এসব কাজ করে সুখ অনুভব করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন