নৌকার মাঝি ফাহ্মী গোলন্দাজ বাবেল ধানের শীষ পেতে নবীন-প্রবীণের লড়াই
দেশের অন্যতম আলোচিত নির্বাচনী আসন ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও)। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখানেও বইছে নির্বাচনী হাওয়া। আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের তথা ‘নৌকা’র দূর্গ হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ সাল থেকে এই আসনে ‘নৌকা’ অপরাজিত। এখানে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এখনো অনেকটাই এলোমেলো; তাই এবার এই নির্বাচন বিএনপি তথা ‘ধানের শীর্ষ’-এর জন্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।
৯১-এর নির্বাচনে এই আসনে নৌকার জয়ের সূচনা হয়েছিল মরহুম আলতাফ হোসেন গোলন্দাজের হাত ধরে; যিনি টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান পদেও বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতায় গফরগাঁও আওয়ামী লীগের শক্ত দূর্গ হয়ে ওঠার পাশাপাশি এলাকার মানুষের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ২০০৭ সালে তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসেবে রাজনীতিতে আসেন ছেলে ফাহ্মী গোলন্দাজ বাবেল; যিনি বর্তমানে এই আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
আলতাফ গোলন্দাজের মৃত্যুর পর ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু বিজয়ী হয়েই এলাকায় নানা অপকর্ম করে বিতর্কিত হওয়ায় নির্বাচনী রাজনীতির ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ নেতৃত্ব ফাহ্মী গোলন্দাজ বাবেলের হাতে চলে আসে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তথা নৌকার হাল; সেই নির্বাচনে তিনি লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে বাবার মতো বাবেলও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এলাকায় জনশ্রæতি রয়েছে, বাবার আসনে বাবেল গোলন্দাজ শুধু সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই অবতীর্ণ হননি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনিও গফরগাঁও আওয়ামী লীগকে সুসংহত করে চলেছেন। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দলের প্রার্থীদের জয়ের মধ্য দিয়েই এর প্রমাণ মিলেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বাবেল গোলন্দাজই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন বলে দলীয় নেতাকর্মীসহ এলাকার জনগণ মনে করছে। কেননা, এমপি হওয়ার পর তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডের উদ্যোগ নেন। গফরগাঁও পৌরসভাসহ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে গ্রামে তার উদ্যোগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়ত নৌকার সমর্থনে উঠান বৈঠক ও পথসভা করছে। ফলে ভোটের রাজনীতিতে তিনি বেশি আলোচিত ও সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
অবশ্য বাবেল গোলন্দাজ ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী বেশ কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আনন্দমোহন কলেজের সাবেক ভিপি অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলাল আহমেদ, সাবেক মেয়র ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক আলহাজ অ্যাডভোকেট কায়সার আহমেদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহŸায়ক ওবায়দুল্লাহ আনোয়ার বুলবুল রয়েছেন। এর মধ্যে মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল ময়মনসিংহ সদর আসনেও প্রার্থী হতে চান বলে গুঞ্জন রয়েছে।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে এই আসনে স্থানীয় পরিমন্ডলে জয় না পাওয়া বিএনপি সাংগঠনিকভাবে ও নেতৃত্বে কিছুটা এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে। তবু একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নেতাকর্মীরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করবেন বলে ধারণা করা যায়। অবশ্য নৌকার দূর্গে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনকে কতটা প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ করতে পারবে, তা নির্ভর করছে প্রার্থী বাছাইয়ের ওপর। দলের প্রবীণ নেতৃত্বের সঙ্গে তারুণ্যের ক্রেজও মনোনয়ন লড়াইয়ে আসতে পারে। ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটির নেতাকর্মীরা।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দুইবার এই আসনে জয় পায় বিএনপি। অর্থাৎ জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে প্রথমবার এবং খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারির নির্বাচনে দ্বিতীয়বার বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আলহাজ ফজলুর রহমান সুলতান। পরবর্তীতে নির্বাচনী রাজনীতিতে তার প্রবল প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে ওঠেন তার ভাই বর্তমান উপজেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি এ বি সিদ্দিকুর রহমান। বর্ষীয়ান নেতা সিদ্দিকুর রহমান এবারও দলীয় মনোনয়নের জন্য লড়বেন। যদিও এই লড়াইয়ে তার সমান্তরালে সাবেক এমপি ও উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরহুম ফজলুর রহমান সুলতানের ছেলে মো. মুশফিকুর রহমানও রয়েছেন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন মুশফিকুর রহমান।
এই দুইজন ছাড়াও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা হলেনÑজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ময়মনসিংহের মিন্টু কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবুল কাশেম (আরজু), ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্রদলের সভাপতি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ড. মীর মিজানুর রহমান এবং জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আক্তারুজ্জামান বাচ্চু প্রমুখ ।
এছাড়া জাতীয় ওলামা পার্টির সভাপতি ও বাংলাদেশ রেডিও টেলিভিশন ভাষ্যকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্বারী হাবিবুল্লাহ বেলালী, মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ছেলে আহমদ বদরুদ্দীন খানের নামও নির্বাচনী মাঠে শোনা যাচ্ছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গফরগাঁওয়ে এ পর্যন্ত দুইবার এমপি ছিলেন আবুল হাশেম (আওয়ামী লীগ), এরশাদ আমলে দুইবার এমপি ছিলেন এনামুল হক জজ মিয়া (জাতীয় পার্টি), জিয়া ও খালেদার সময় (১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রæয়ারী) দুইবার এমপি ছিলেন ফজলুর রহমান সুলতান (বিএনপি), আর ৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত টানা তিন টার্ম এমপি ছিলেন আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ (আওয়ামী লীগ); এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (আওয়ামী লীগ) এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ফাহ্মী গোলন্দাজ বাবেল (আওয়ামী লীগ) বিজয়ী হন। অতীত ফলাফলের হিসেবে আগামী নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনা ‘সুদূরপরাহত’ বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে নামতে পারে, তবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা জমতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
গফরগাঁও উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ৮ ইউনিয়ন নিয়ে সম্প্রতি পাগলা নামে একটি থানা হয়েছে। দুই থানা ও এক পৌরসভা নিয়ে এই নির্বাচনী এলাকা। এখানে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৭ হাজার ৬ শ ৩৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬শ ৬৬ জন এবং নারী ১ লাখ ৬১ হাজার ১ জন।
এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী বর্তমান এমপি ফাহ্মী গোলন্দাজ বাবেল। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ‘গফরগাঁও এক কথায় আওয়ামী লীগের দূর্গ। আর এই দূর্গ গড়ার পেছনে আমার বাবা মরহুম আলতাফ হোসেন গোলন্দাজের অনন্য ভ‚মিকা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে এবং প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে বাবার মতো আমিও দলের জন্য, দেশের জন্য ও এলাকার মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছি। আশা করি, এবারও দলের মনোনয়ন আমি পাব এবং দলের সব নেতাকর্মী তথা গফরগাঁওয়ের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার বিজয় ধরে রাখবে।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহŸায়ক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আশরাফ উদ্দিন বাদল ইনকিলাবকে বলেন, ‘ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল এমপির নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। গফরগাঁওয়ে প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে।’
অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মো. মুশফিকুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ‘আমার বাবা সাবেক এমপি মরহুম ফজলুর রহমান সুলতানের হাতে গড়া গফরগাঁও উপজেলা বিএনপি তৃণমূল পর্যায়ে খুবই শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে আমি রাজনীতি করি। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে ইনশাআল্লাহ বিজয়ী হব।’
উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম আর খায়রুল ইনকিলাবকে বলেন, ‘বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা তৃণমূলে খুবই শক্তিশালী। এবার যোগ্য প্রার্থীকে দল মনোনয়ন দিলে অবশ্যই বিজয়ী হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমাদের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
লংগাইর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ¦ আবদুল্লাহ আল-আমিন বিপ্লব ইনকিলাবকে বলেন, এ ইউনিয়ন থেকে আমি প্রথমে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছি। বর্তমান এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলকে পুনরায় মনোনয়ন দেয়া আবারও বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে ইনশাল্লাহ। প্রতিটি ওর্য়াডে এখন আওয়ামী লীগের সংগঠন শক্তিশালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন