শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

হরিণ নিধনে বাড়ছে চোরা শিকারিদের তৎপরতা

রাসমেলায় বন বিভাগের ৮টি পথ নির্ধারণ

কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা) উপজেলা সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আগামী ২-৪ নভেম্বর ২০১৭ চন্দ্রিমার আলোক মালায় শোভিত নীরব চরাঞ্চল সরব হয়ে উঠবে পুণ্যার্থীদের প্রার্থনা আরাধনায় দুবলার চরে রাস মেলা। সাগর প্রকৃতির অভাবনীয় সৌন্দর্যের মাঝে পুণ্য অর্জন আর আনন্দ-সঞ্চার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এ মেলায় দর্শণার্থীরা যান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভাবনীয় রূপমঞ্জরী ভরে উপভোগ করতে। নীরব সুন্দরবন প্রতি বছরের এই উৎসবের দিনগুলোতে যেন লোকালয় হয়ে জেগে ওঠে। বনের বুক চিরে জালের মতো ছড়ানো নদীগুলোতে লঞ্চ, ট্রলার-ইঞ্জিন নৌকার অবিরাম চলে ভটভট আওয়াজ। রাসমেলায় আগমনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রী ও দর্শানার্থীরা। মেলায় দর্শনার্থী ও পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তায় বনরক্ষীদের পাশাপাশি র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের কঠোর টহল ব্যবস্থা। এখন মাছের মৌসুম সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া প্রায় ১২ হাজার জেলে অস্থায়ী ডেরা গেড়েছে দুবলার চরে। পাখির কুজন সবচেয়ে আকর্ষণীয় হরিণ তার অপরূপ মায়াবী চোখ ও দেহসৌষ্ঠব দিয়ে সুন্দরবনে বেড়াতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। দুবলার চরের আশেপাশে হরিণের পাল দেখা যায় বেশি। আছে অসংখ্য বানর, মদনট্যাক, মাছরাঙা। ভাগ্য থাকলে বাঘের পদচিহ্ন দেখা যেতে পারে। সাগর উপক‚লে প্রশস্ত বনভ‚মি।
পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভ‚মি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলাজুড়ে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের ভাগে। রাসমেলাকে ঘিরে প্রতি বছর হরিণ শিকারিদের তৎপরতা চলে। মেলার দুই সপ্তাহ বাকি থাকতেই শুরু হয়েছে চোরা শিকারীদের হরিণ শিকারের তৎপরতা। ইতোমধ্যে চোরা শিকারীরা বিভিন্ন ছদ্মা বরণে প্রবেশ করতে শুরু করেছে বনাঞ্চলে। অনেকে বনজীবি সেজে বনবিভাগ থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারের ফাঁদসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে ঢুকে পড়ছে বন অভ্যন্তরে। বিশেষ করে সুন্দরবন সংলগ্ন আটটি উপজেলার প্রায় শতাধিক শিকারিচক্র মেতে ওঠে মায়াবি চিত্রল হরিণ নিধনের মহোৎসবে। পরিবেশবিদদের ধারণা, সারা বছর সুন্দরবন থেকে যে পরিমাণ হরিণ শিকার হয় রাসমেলাকে ঘিরে তার চেয়ে বেশি-সংখ্যক হরিণ শিকার হয়ে থাকে। বনবিভাগের পক্ষে মেলাকে ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, মেলা উপলক্ষে রাস পূর্ণিমায় নিরাপদে যাতায়াতের জন্য তীর্থযাত্রীদের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ আটটি পথ নির্ধারণ করেছে। এ সকল পথে বন বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনী যাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। নাইলনের ফাঁদ, জাল পেতে, স্প্রিং বসানো ফাঁঁদ, বিষটোপ, তীর বা গুলি ছুড়ে, কলার মধ্যে বড়শি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁদসহ পাতার উপর চেতনা নাশক ওষুধ দিয়ে নিধন করা হয়ে থাকে বিপুলসংখ্যক হরিণ। শুধু এখানেই শেষ নয়, কোনো ফাঁদে হরিণ ধরা পড়লে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানরত শিকারীরা ছুটে গিয়ে আটক হরিণকে লাঠিপেটা করে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে জবাই করে। এরপর চামড়া, শিংসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পাঠিয়ে দেয়া হয় উপযুক্ত ক্রেতাদের কাছে। মেলা উপলক্ষে দর্শনার্থী ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব চোরা শিকারীরা সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, আলোর কোল, কটকা, কচিখালী দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালী, তালপট্টিসহ যে সকল এলাকায় হরিণের বেশি বিচরণ শিকারীরা সে সব এলাকায় ফাঁদ দিয়ে শিকার করে হরিণ। তবে এবার মেলাকে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠোর। এ জন্য সুন্দরবনজুড়ে বন বিভাগ, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে মেলা চলাকালীন জারি করা হবে অঘোষিত রেড এলার্ট। বাতিল করা হয়েছে বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি। এত নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে কীভাবে এবং ঠিক কি পরিমাণ হরিণ শিকার হয় তাই-ই এখন দেখার বিষয়। হরিণ নিয়ে এমন চিত্র বলে দেয় সুন্দরবনের গহীনেও ভাল নেই অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় নিরীহ প্রাণীরা। খুলনার কয়রা উপজেলার, পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের, শ্যামনগর জনপদের বহু মানুষ এক প্রকার পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন হরিণ শিকার। সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা, পাইকগাছা শ্যামনগরের এলাকায় কেজি প্রতি হরিণের গোস্থ পাওয়া যায় মাত্র চার-পাঁচ শ’ টাকায়। কখনো কখনো তাদের দু’-এক জন গ্রেফতার হলেও অধিকাংশই রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে বনবিভাগের চেয়ে পুলিশের হাতে গোশত উদ্ধারের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
এদিকে রাসমেলা উপলক্ষে বন বিভাগ আটটি পথ নির্ধারণ করেছে। সেগুলো হলো ১, বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাঁলানদী-বলনদী-পাটকোষ্টা হংসরাজ নদী হয়ে দুবলারচর। ২, কদমতলা হতে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলারচর। ৩, কৈখালী স্টেশন হয়ে মাদারগাং, খোপড়াখালী ভাড়ানী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলারচর। ৪, কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাসিটানা, বজবজা হয়ে আড়ুয়া শিবসা-শিবসা নদী-মরজাত হয়ে দুবলারচর। ৫, নলিয়ান স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলারচর। ৬, ঢাংমারী-চাঁদপাই স্টেশন হয়ে পশুর নদী দিয়ে দুবলারচর, ৭, বগী-বলেশ্বর-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলারচর। ৮, লোকালয় থেকে বহুদূরে সুন্দরবনের দক্ষিণে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে বিচ্ছিন্ন চর দুবলার আলোরকোলের এই রাস উৎসব ধারণ করে আছে বহু বছরের ইতিহাস।
ধারণা করা হয়, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে এক হিন্দু সাধু এই মেলা শুরু করেছিলেন। এই সাধু ২৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে গাছের ফলমূল খেয়ে জীবনযাপন করতেন। অন্য মতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পুণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। সেই থেকে শুরু হয় রাসমেলার। শত শত নৌকা-ট্রলার ও লঞ্চের সমাগমে স্থানটি সজ্জিত হয়ে ওঠে আলোর ঝলকে। সন্তানহীন ধর্মনুরাগী হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকেরা দুবলার মেলায় মানত করেন এবং মেলায় এসে মানতকারীরা আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে থাকেন। মেলায় বাদ্য, নৃত্য, গীত ও বিবিধ প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। পসার বসে কুটির শিল্পের দোকান ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ফল-ফলাদি, মিষ্টান্ন, মনোহারির সামগ্রীর। এ মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও আসেন ভারত, আমেরিকা, মিয়ানমারসহ আশপাশ দেশের বিদেশি পর্যটক। রাশ মেলা ২০১৭ বিষয়ে , সাতক্ষীরা বন বিভাগের এসিএফ সৈয়েব খান দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, রাসমেলাকে-২০১৭ ঘিরে বন বিভাগের তরফ থেকে তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের কঠোর নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। মেলাকে ঘিরে সকলের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কেউ যদি অপরাধ সংগঠিত করে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা আশা করছি, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে রাসমেলা সমাপ্ত হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন