রাজধানীতে ১২ঘণ্টা ব্যবধানে দু’টি জোড়া খুনের ঘটনায় রাজধানীর সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। নিজ বাসায় মা-ছেলে ও বাবা-মেয়ে খুন হওয়ায় মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা হলে কি আমরা নিজ বাসাতেও নিরাপদ নই? যদিও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতরাও ধরা পড়ছে। অন্যদিকে কাকরাইলের রাজমণি-ইশা খাঁ হোটেলের বিপরীত পাশের ৭৯/১, মায়াকানন নামের বাসার মা-ছেলে খুনের ঘটনায় গৃহকর্তা আব্দুল করিমের তৃতীয় অভিনেত্রী শারমিন আক্তার মুক্তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ তথ্য পেয়েছে পারিবারিক বিরোধের জের ধরে ভাড়াটিয়া খুনিকে দিয়ে ওই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তাছাড়া বাড়ির মালিক ব্যবসায়ী করিমসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। উত্তর বাড্ডার ময়নারবাগের বাসায় বাবা জামিল (৩৮) ও মেয়ের নুসরাত (৯) খুনের ঘটনায় এখনও রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রীকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন মানার প্রবণতা কমে যাওয়া, দ্রুত বিচার না হওয়া এবং জড়িতদের গ্রেফতারে বিলম্ব হওয়াই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বিপিএম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আতংকিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছুই নেই। প্রয়োজন সকলকে সর্তক হওয়া। রাজধানীসহ সারাদেশেই হত্যাসহ কোন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর পুলিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। যে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে জড়িতদের কোন ভাবেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বিপিএম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, প্রত্যেকেরই উচিত প্রাথমিক অবস্থায় নিজেদের নিরাপত্তার দিকে নজর দেয়া। সাথে সাথে কোন ধরনের হুমকি বা অন্য কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে নিকটস্থ থানায় অবহিত করা। তা হলে পুলিশ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে এবং সমাজে অপরাধীরা দ্রুত গ্রেফতার হবে। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হত্যাসহ যেসব অপরাধ সংঘটিত হয় তা পুলিশের পক্ষে প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা কমে যাচ্ছে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে গেছে। অপরাধীরা ধড়া পড়ছে কম এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধের বিচার হচ্ছে না। দেশে পেশাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতাও এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দায়ী। হত্যাসহ বড় ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে কি করা প্রয়োজন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ সকলকে আইন মানার প্রবণতা থাকতে হবে। কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর দ্রুত ওই অপরাধীকে গ্রেফতার এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রাজধানীর পল্টনের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দু’টি জোড়া খুনের ঘটনার পর এক ধরনের ভয় আমাদের মধ্যে কাজ করছে। কখন কি ঘটে যায় তা নিয়ে বেশ চিন্তায় রয়েছি। বাসা থেকে স্ত্রী দুপুরে ফোন করে জানতে চেয়েছে কেমন আছি। এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে সকলের মধ্যে। তিনি বলেন, যদি দ্রুত এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন এবং জড়িতরা ধরা পড়ে তা হলে এই অস্থিরতা থাকবে না। গতকাল রাজধানীর বেশ কয়েকজন বাসিন্দা নিজেদের মধ্যে আতংকের কথা জানিয়েছেন এই প্রতিবেদককে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কাকরাইলে বাসায় ঢুকে মা ও ছেলেকে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে গৃহকর্তা আব্দুল করিমের তৃতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী শারমিন আক্তার মুক্তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বুধবার সন্ধ্যার এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাড়ির মালিক ব্যবসায়ী করিমসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাতেই থানায় নিয়েছে পুলিশ। তাকে পুলিশ হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) রমনা বিভাগের এডিসি নাবিদ কামাল জানান, নয়া পল্টনের একটি বাসা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য করিমের তৃতীয় স্ত্রী মুক্তাকে আটক করা হয়। আব্দুল করিম তিনটি বিয়ে করেছেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর চার বছর আগে তিনি মুক্তাকে বিয়ে করেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুক্তাকে আটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকেও খুঁজছি। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশ জানায়, ব্যবসায়ী করিম এফডিসিকেন্দ্রিক বাংলা সিনেমার প্রযোজনায়ও যুক্ত। বেশকিছু সিনেমা পরিচালনাও করেছেন তিনি। তার তৃতীয় স্ত্রী মুক্তা সিনেমার অভিনয় শিল্পী। তমা সেন্টারের পাশের গলির যে বাড়িতে হত্যাকাণ্ড ঘটে তার পেছনেও ব্যবসায়ী করিমের ছয়তলা একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া নয়া পল্টনে পলওয়েল মার্কেটে তার দোকান রয়েছে। যে বাড়িটিতে হত্যাকাণ্ড ঘটে তার পঞ্চম তলার এক পাশে করিম তার স্ত্রী শামসুন্নাহার ও ছোট ছেলে শাওনকে নিয়ে থাকতেন। অন্য পাশে কেউ থাকতেন না। তবে হত্যাকাণ্ডের সময় করিম ঘরে ছিলেন না। ওই সময় ফ্ল্যাটে থাকা শামসুন্নাহারের গৃহকর্মী রাশিদার ভাষ্য, গত বুধবার সন্ধ্যায় তিনি রান্নাঘরে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের সময় কে বা কারা রান্নাঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়। এসময় ঘর থেকে চিৎকারও শুনতে পান তিনি। পরে ওই ভবনের দারোয়ান নোমান এসে রান্নাঘরের ছিটকিনি খুলে দিলে বাইরে বের হয়ে হত্যার বিষয়টি দেখতে পান তিনি। আর ভবনে দারোয়ান কাম তত্ত্বাবধায়ক নোমান বলছেন, ওপর থেকে একজন লোক নিচে এসে বলে, ওপরে যান, সেখানে মারামারি লাগছে। তখন তিনি উপরে উঠে পাঁচ তলার সিঁড়িতে শাওনের লাশ ও ভেতরে শামসুন্নাহারের লাশ দেখতে পান। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, অন্য স্ত্রীদের নিয়ে পারিবারিক কোনও ঝামেলার কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই সূত্র জানায়, কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। পারিবারিক কলহ নাকি বাইরের কেউ অন্য কোনও কারণে দুজনকে হত্যা করেছে, তা জানার চেষ্টা চলছে। দুটি মৃতদেহের সুরতহাল প্রস্তুতকারী রমনা থানার এসআই আতোয়ার হোসেন বলেন, শাওনের গলাকাটা ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শামসুন্নাহারের থুতনি, বুক ও পেটে ছুরিকাঘাতের জখম। জানা গেছে, আবদুল করিম ও শামসুন্নাহার দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে নিহত শাওন সবার ছোট। তাদের বড় দুই ছেলে লন্ডন ও কানাডায় থাকেন। প্রতিবেশীরা জানায়, কিছুদিন আগে আব্দুল করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার ভাই ওই বাসায় গিয়ে প্রথম স্ত্রীকে হুমকি-ধামকি ও মারধর করেন। এর কয়েক দিনের মাথায় এ ঘটনা ঘটল। পুলিশের ধারণা, ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। হত্যা মিশনে একাধিক ব্যক্তি অংশ নেয় বলেও ধারণা পুলিশের। হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা গেছে কি না-জানতে চাইলে রমনা থানার ওসি মাইনুল হক বলেন, যেহেতু আব্দুল করিম তিনটি বিয়ে করেছেন। তাই পারিবারিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত কাজ করছি। তবে ব্যবসায়িকসহ অন্যান্য বিষয়ও মাথায় রেখেছেন বলে মন্তব্য করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেন, দুটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। তবে দুটি হত্যাকাণ্ডেই পারিবারিক ক্ষোভ-কলহ, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা বা সম্পর্কের টানাপোড়নের ঘটনা থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন