শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

শিক্ষার মান : সরকারি বনাম বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
নতুন বছরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্থানে স্থানে রকমারি ব্যানার, বিজ্ঞাপন, লিফলেট ইত্যাদি বণ্টন করা হয় বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। এদের হাতে ভবিষ্যৎ সমর্পণ করে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে সমাজ, দেশ এবং জাতি। বছর শুরু হয়, একদিন শেষও হয় কিন্তু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যায়। আজকালের এ সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থার কদর্য রূপ আর শিক্ষক সমাজের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা লোকের অভাব নেই। অথচ ক’জন আন্তরিকভাবে খুঁজি এ থেকে উত্তরণের পথ, এ সমস্যার আশু সমাধান, সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন। সরকারি স্কুলগুলোর রাহুর দশা চলছে। হালচাল খারাপ। অনেকগুলোতে ছাত্র নেই, শিক্ষক নেই, লাইব্রেরি নেই- পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ, দুর্নীতির ‘ঘুণ’ বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন প্রকল্পের হাত ধরে, এসব শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। গ্রামের মোড়ল-মাতব্বর, চেলাচামুন্ডা থেকে শুরু করে শিক্ষার এবিসি না জানা ব্যক্তিরাও শিক্ষকদের গালমন্দ করেন, শিক্ষার ধরন নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তোলেন। আর তুলবেন নাই বা কেন। আসলে শুধু শুধু আমজনতার ঘাড়ে দোষ দিয়েই কী লাভ। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। কিছু একটা ঘটছে বলেই লোকমুখে এমন সব কথা উচ্চারিত হয় একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেন বা সরকারি স্কুলের এই হাল, এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের কী করণীয় সে প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতেই হয়।
দেশে বর্তমানে যে ব্যবসাটা বেশ মুনাফার মুখ দেখছে, সেটা হচ্ছে এডুকেশন বিজনেস। সিলেট অঞ্চলে ব্যাপারটা বেশ রমরমা। অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে প্রাইভেট স্কুল। সাল ২০১৬-র শুরুতে এই কলমচির দেখা মতো নতুন করে স্থাপিত হওয়া স্কুলের সংখ্যাটা বেশ। হালফিল সবাই নিজের মতো করে স্কুল খুলছেন। চিত্তাকর্ষক ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, আবাসিক ইসলামী, অ্যাংলো-বেঙ্গলি ইত্যাদি বিভিন্ন বিশেষণে নিত্যদিন আত্মপ্রকাশ করছে বেসরকারি স্কুল। বৃহত্তর সমাজব্যবস্থায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষা আনয়ন করে সমাজকে ত্বরান্বিত করাই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একমাত্র উদ্দেশ্য। সমাজে শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের গুরুদায়িত্ব পালন করার আশ্বাস দিয়ে ছাত্র জোগার করতে এসব প্রতিষ্ঠান জনতার দুয়ারে আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। অভিভাবকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটাচ্ছে। এর ফলে জনতার মনে সরকারি স্কুলগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণার উদ্রেক আর ঘৃণার জন্ম হচ্ছে। এর উপর সরকারের উদাসীনতা আর দ্বিচারিতা সরকারি স্কুলগুলোর বেহাল রূপকে আরও দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে তুলেছে। সরকারি স্কুলে ছাত্র ভর্তির জন্য ভুলেও কেউ ‘ভর্তি চলছে’ নামে পোস্টার টাঙ্গায় না, লিফলেটও ছাপায় না। এগুলোতে ছাত্র আসবে কী করে, আসার কথাও নয়। ছাত্র না এলে শিক্ষকরা না এলে পড়াশোনা হবে কী করে? আর শিক্ষকরা না এলে পড়াশোনা হবে কী করে? কীভাবে বাড়বে শিক্ষার মান। এসএমসি, ভবন, শৌচালয়, লাইব্রেরি, কম্পিউটার আর খানাপিনার সব আয়োজন সম্পন্ন অথচ ছাত্র নেই। অতিথির জন্য রকমারি খাবার রাখার পরও যখন তিনি গরহাজির থাকেন তখন গৃহকর্তার মনে কতটুকু কষ্ট হয় সেটা সহজেই অনুমেয়। খাবারগুলো সেখানে অপেক্ষা করতে করতে বিনষ্ট হবেই, এভাবেই আমাদের সমাজে বিনষ্ট হচ্ছে সরকারের লাগানো শিক্ষার পরিবেশ।
কেউ কেউ বলেন, সরকারি স্কুলে ভর্তি করা মানে ছাত্রদের মাথা খাওয়া। আসলে মাথা কখনোই বিনষ্ট হয় না। বরং, বিনষ্ট মাথাওয়ালা ছাত্রগুলোই সেখানে যায়। দেখা যায়, যে ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা সামান্য ভাল কিংবা পরিবার কোনও রকমে চলছে, সে-ও তার বাচ্চা দাঁতে দাঁতে চেপে প্রাইভেট স্কুলে পাঠিয়ে দিতে চায়। কারা পা মাড়ায় সরকারি স্কুলের বারান্দায়? দেয়ালে পিঠ ঠেকা সমাজের নি¤œবিত্ত পরিবারের সেই ব্যক্তি, যার অক্ষরজ্ঞান নেই, যার চৌদ্দপুরুষ স্কুলের গ-ি দেখেনি, যার ঘরে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার নেই, যে সন্ধ্যা হতেই বিবি-বাচ্চা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তার হারাধনগুলোই এসব স্কুলের যাত্রী। ওদের স্কুল যাত্রার বর্ণনা শুনলে মনে আলাদা অনুভূতির সঞ্চার হয়। সরকারি স্কুলের ছাত্রগুলোর ধুলোয় গড়াগড়ি করে খেলতে খেলতে সময় হলে হঠাৎ সামনে পাওয়া বইপত্র নিয়ে দৌড়ে চলে স্কুল অভিমুখে। স্কুলে তাদের কাছে পড়ার আঙিনা বলে কখনোই মনে হয় না। ওরা স্কুলে কখন, কীভাবে, কী নিয়ে আসতে হয় সেটাও ভুলে যায়। শিক্ষা সামগ্রীগুলো তাদের কাছে আর পাঁচটা খেলনার মতো। অবাক করা গল্প হলেও সত্যি, সরকারি স্কুলের এমন পড়ুয়া দেখেছি, যারা পাঠ্যবই থেকে সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো ব্লেড দিয়ে কেটে তুলে রাখে। খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে মুখে ঢোকায়, চানাচুর খায়। বইখাতার মূল্য তাদের কাছে নেই, ছিল না, আর থাকার কথাও নয়। খাতায় শিক্ষক কিছু লিখে দিলে ওরা এর উপর চায়ের দাগ ফেলে, আঁকাবাঁকা করে, কাঁচি দিয়ে কেটেও ফেলে। একজন নিজের ছেলের গল্প করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, ক্লাস টিচার অজ্ঞানবশত খাতায় একটা বানান ভুল লিখে ফেলেছিলেন। তিনি সেটা কলম দিয়ে শুদ্ধ করতে গেলে ছেলেটা কিছুতেই রাজি হলো না। জেলা শিক্ষা অফিসার জোর করে বানানটা কেটে শুদ্ধ করে দিলেন। রাগে-দুঃখে-অপমানে ছেলেটা না খেয়ে সারারাত কেঁদে কাটিয়ে দিল। বাবা বুঝিয়ে-শুনিয়ে বললেন, দেখ বাবা, আমি গোটা জেলার শিক্ষকদের শিক্ষক, যেটা শুদ্ধ করে দিয়েছি সেটাই ঠিক। ছেলেটা কিছুতেই মানল না। বলল, আপনি ডিইও হলে কী আসে যায়, আমার স্যারের লেখার উপর কলম ধরা মানব না, হোক সেটা ভুল। এই হচ্ছে প্রাইভেট স্কুলের গুরু-শিক্ষকদের সম্পর্ক। অথচ একই বয়সের সরকারি স্কুলের ছাত্ররা শিক্ষকের লাল কালির কত লেখা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে, খাতায় দস্তখত দিলে এর উপর ওভাররাইটিং করে তার খবর আমরা রাখি? অভিভাবকের সামনে ওরা এসব কাজ অনায়াসেই করে, তারাও সেটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। অতএব, বেসরকারি স্কুলে ঠিক তার বিপরীত, আমরা যেন সে কথা বুঝেও বুঝে উঠতে পারি না।
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ থাকা চাই। যত্রতত্র শিক্ষা হয় না। আগেকার মতো গাছতলায় বসে শিক্ষার আলো পাওয়া এখন আকাশকুসুম ব্যাপার। শিক্ষাদানে পাঠানোর আগে একটা সন্তানকে ঠিকমতো প্রস্তুত করে স্কুলে পাঠাতে হয়। সে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছে, সেটা যাতে উপলব্ধি করতে পারে তার জন্যই এই প্রস্তুতি। কতজন সরকারি স্কুলে পড়ুয়া সন্তানের মা এ দিকটায় খেয়াল রাখেন? পক্ষান্তরে, উচ্চ কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েরা তাদের সন্তানদের সাবান সহযোগে গোসল সারিয়ে মাথায় সুগন্ধি তেল মাখিয়ে টাই-জুতা পরিধান করিয়ে স্কুলে উপস্থিত হওয়ার পর সম্মুখীন হয় আলাদা এক শিক্ষণীয় পরিবেশের। সঙ্গে পেয়ে যায় সমসাময়িক পরিবার থেকে আসা পরিচ্ছন্ন ছেলেমেয়েদের। অতএব এমন পরিস্থিতিতে শিশুমনে শিক্ষার্জনের মানসিকতা আসাটা স্বাভাবিক। অপরপক্ষে ধুলো থেকে এবড়ো খেবড়ো চুল আর ময়লাযুক্ত ছিন্ন কাপড় নিয়ে উঠে আসা ছাত্রদের মগজে শিক্ষা ঢোকানো একজন শিক্ষকের পক্ষে বেশ কঠিন। শিক্ষার মনোরম পরিবেশ আমদানির জন্য শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত হওয়া উচিত।
সর্বশিক্ষা অভিযানের গাইড লাইন অনুসরণ করতে গিয়ে আজকালের শিক্ষকরা বেত হাতে নিয়ে ধমক দিতে চান না। এতে ছাত্ররা পার পেয়ে যায় যা ইচ্ছে তা করে। বেচারা শিক্ষকও নিরুপায়। ফলে ছাত্রসমাজের কাছে শিক্ষককুলের সম্মানে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, সম্মান নামক বস্তুটা জোর করে আদায় করা যায় না। উচ্চ প্রাথমিক কিংবা হাইস্কুলের বেলায় সে কথা খাটে কিন্তু প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রদের বোধশক্তিকে জাগ্রত করে শুধু শুধু আপসের মাধ্যমে শিক্ষাদান বেশ দুরূহ ব্যাপার। স্কুল থেকে পড়াশোনার জন্য চাপ দেয়া হলে ছাত্ররা অহরহ স্কুল ফাঁকি দেয়। অভিভাবকরা সে দিকটা মোটেই খেয়াল করেন না। স্কুলে কী পড়া হলো, ছেলেমেয়ে কতটা পড়ল, শিখল, জানল সেটার হিসাব ভুলেও করেন না। প্রায়শই দেখা যায়, নিজের সন্তান মাসের পর মাস স্কুলে পা মাড়াচ্ছে না, এমন অভিভাবকও স্কুলে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, খড়্গহস্ত হন প্রধান শিক্ষকের উপর। এসএমসি গঠনের আসল উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে শিক্ষার মান উন্নত করা যায়, ছাত্রদের মানসিক ও শৈক্ষিক বিকাশ সাধন করা যায়। অথচ যে শিশুসন্তানদের জন্য এত আয়োজন তাদের কথা ছেড়ে জনতা প্রতিহিংসাবশত জড়িয়ে পড়েন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোতে, পাঠদানের উন্নতিকল্পে যেগুলোর সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। সব কিছুরই খবর রাখা জরুরি, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে সেগুলো যাতে ছাত্র এবং শিক্ষাবহির্ভূত না হয়। গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই মীমাংসা সম্ভব। শুধু কাদা ছোড়াছুড়ি করে লাভের লাভ কিচ্ছু হবে না, সকলের ব্যাপারটা অনুধাবন করা উচিত।
সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ব্যর্থতার দায় অনুসন্ধান না করে অভিভাবকরা শুধু শুধু শিক্ষকদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেন। ছেলেমেয়ে কিচ্ছু জানে না, এমন অনেক অভিভাবককে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারাই ওকে মানুষ করে দিন।’ কথায় বলে, গৃহই সবচেয়ে বড় বিদ্যালয় আর মা-বাবাই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। একটা সন্তানকে তার মা-বাবা যতটা সময় কাছে পান, তার এক-চতুর্থাংশ সময় শিক্ষকরা পান। আর এই চার ভাগের একভাগ সময়ের ভেতর ওকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পাঠ চুকিয়ে মানুষ করে দেবেন শিক্ষকরা- এমন ভাবনা অবান্তর। অতএব অভিভাবকদের শিক্ষকদের তুলনায় চারগুণ সচেতন হতে হবে। তবেই আসবে সাফল্য, নইলে নয়। এ জায়গায় আমাদের গোড়ায় গলদ। শিক্ষক বেশ মনোযোগ সহকারে পাঠদান করিয়ে বাড়ি থেকে শিখে আসার জন্য বললেন। অথচ বাড়িতে আসার পর সন্ধ্যা পেরনো মাত্র আপনার সন্তানটাকে দুধকলা সহযোগ খাইয়ে-দাইয়ে ৭/৮টার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। অতএব শিক্ষার বিকাশ হবে কীভাবে? শিক্ষক পড়াশোনার জন্য চাপ দিলেন। পরদিন ছেলেটা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কুলে গেল না। এ হচ্ছে আজকের সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের চরিত্র। খাতাপত্র ঠিকমতো আছে কিনা, এসব দেখাশোনা করার সময় নেই সরকারি স্কুলের অভিভাবকের। অথচ প্রাইভেট স্কুলগুলোতে ভর্তি করে দিলেই সেই অভিভাবকের সচেতনতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আসলে বিনা পরিশ্রমে পাওয়া বস্তু যেমন মূল্যহীন, সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের অবস্থা ঠিক একই রকম। ‘তেলা মাথায় তেল দেয়া মনুষ্য জাতির রোগ’। ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করে দিলে অহরহ খবরাখবর রাখেন, খাতা দেখেন, স্কুলে সভা হলে সব কাজ ফেলে উপস্থিত হন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিজও আদায় করেন। গাঁটের পয়সা খরচ করলে তখনই সে শিক্ষার গুরুত্ব বেড়ে যায়। আমরা যারা শিক্ষাব্যবস্থাকে দোষারোপ করি তাদের কাছে শিক্ষার গুরুত্ব কম। সেদিন দেখলাম এক অভিভাবক ছেলের জন্য কলম কিনতে এসে সবচেয়ে কমদামি কলম কোনটা সেটা খুঁজছেন। তিন টাকার দামের দুটো কলম বের করে দেয়ার পর সেই ব্যক্তি বললেন, পাঁচ টাকায় দুটো পাওয়া যায় এমন কলম নেই? ‘আমি এমন কলম খুঁজছি’ সে কথা বলে বেচারা কেটে পড়লেন। এর অব্যবহিত পরেই আরেকজন অভিভাবক এসে ছেলের জন্য দোকান বেছে পঁচাত্তর টাকা দামের কলম নিলেন। আড়াই টাকা দামের মনোবাসনা নিয়ে কলম খোঁজা সেই অভিভাবকের আর্থিক অবস্থা যে এত খারাপ সেটাও নয়। অতএব দুই অভিভাবকের মধ্যে কে প্রাইভেট স্কুলে সন্তান পড়াচ্ছেন আর কে সরকারি স্কুলে পড়াচ্ছেন সেটা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। অতএব পড়া কার মাথায় ঢুকবে, কার সন্তান পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
আজকাল অনেক সরকারি স্কুলে পড়ুয়াদের দেখা মেলে না। সে নিয়ে কাউকে কথা বলতে শোনা যায় না। কিছু কিছু স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত দেখলে চোখ কপালে ওঠে। দেশে এরকম অসংখ্য স্কুল আছে, যেখানে ১০/১৫ জন পড়ুয়া নিয়ে শিক্ষকদের গোটা বছর কাটাতে হয়। বেসরকারি স্কুলের পাশাপাশি সরকারিকরণকৃত স্কুলও এর অন্যতম কারণ। দেশে গ্রামাঞ্চলে হাঁটলে চোখে পড়ে স্কুল আর স্কুল। পাড়ায় পাড়ায় স্কুলের ছড়াছড়ি। কিলোমিটারের ভেতরে দেখা মেলে পাঁচ-সাতটা করে স্কুল। গ্রামের মোট বাচ্চা আর স্কুলের গড় হিসাব করলে প্রতিটি স্কুলে শ’দুয়েক ছাত্র মিলবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া দেখা যায়, একটা ছাত্রের দু-তিনটে স্কুলে নাম রয়েছে। এজন্য অবশ্য প্রধান শিক্ষকরাও অনেকাংশে দায়ী। ছাত্র সংখ্যা বেশি দেখাতে গিয়ে তারা এদের প্রতি কড়া মনোভাব দেখাতে পারেন না। অতএব শিক্ষার পরিবেশ নেই বলে আমরা আমজনতা যে আওয়াজ তুলি, সেটা উঠানোর আগে ছাত্র নেই বলে সুর তোলা উচিত। স্কুলে ছাত্র না আসার কারণসমূহ তদন্ত করে স্কুলগুলোতে পড়ুয়াদের আনতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। ছাত্রদের চাপে ফাঁকি দেয়া শিক্ষকদের স্কুলে পা মাড়তে বাধ্য করি। একসময় দক্ষ-অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অভাব ছিল, যারা ছিলেন এরা দেয়া-নেয়া প্রথার মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিলেন বলে মনোযোগ সহকারে পাঠদান করাতেন না। আজকাল স্কুলে স্কুলে শিক্ষকদের নিয়োগ করা হয়েছে, যারা ফাঁকা স্কুলে বসে ছাত্রদের জন্য হাপিত্যেস করছেন। তাছাড়া ছাত্ররাই বাধ্য করে শিক্ষকদের পাঠদান করাতে, এমন ছাত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত অভিভাবকদের। মানুষ গড়ার জন্য শুধু অন্যের হাতের দিকে না চেয়ে নিজে একটু মনোযোগ দিলেই হলো। প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাদের একটু খেয়াল রাখতে পারলে স্কুলগুলোর বেহাল অবস্থা ঘুচবে, এতে সন্দেহ নেই। ইংরেজি অক্ষর না জানা, নিজের নাম লেখা না জানা হারাধনগুলো প্রাথমিক স্কুলে গ-ি টপকে হাই স্কুলে যায়। অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ার পর কোনো বস্তু মেরামত করা যেমন কঠিন, হাইস্কুলের বেলায় ঠিক তেমনটাই হচ্ছে। এসব স্কুল থেকে এসএসসি পাস করলেও এদের মাথায় ন্যূনতম শিক্ষার আলো পৌঁছায় না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর এদের অবস্থা বেহাল থেকে বেহালতর হয়। এসব পড়ুয়াকে সামনে দেখলে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করেন কলেজ শিক্ষকরা আর দোষারোপ করেন প্রাথমিক ও হাইস্কুলের শিক্ষকদের। সে জন্যই কলেজেও ফল ভাল হয় না। যে চারাগুলো এসব কলেজে আমদানি হয় এগুলোর বীজেই শিক্ষার ছোঁয়া লাগেনি। শক্ত জমিকে উর্বর করতে যেমন বেশি করে চাষের প্রয়োজন তেমনি এসব পড়ুয়াকে ট্র্যাকে আনতে হলে দ্বিগুণ হারে পরিশ্রম দরকার। কিন্তু কে করবে এই পরিশ্রম, কে দেবে এদের সময়? শিক্ষকরা হয়তো হাতের কাছে পাচ্ছেন না, অনেকের সদিচ্ছা নেই, অভিভাবকদের সময় নেই। শিক্ষক, ছাত্র এবং অভিভাবক সবাই জোটবদ্ধ হয়ে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলেই ল্যাটা চুকে যেত, সাফল্য ধরা দিত। কিন্তু আমরা সে পথে হাঁটি না, উল্ট শুধু শুধু কাদা ছোড়াছুড়ি আর গালমন্দ করেই দিন কাটিয়ে চলেছি। লাভের গুড় মাঠে খাচ্ছে পিঁপড়ের দল। স্কুলগুলোর দুর্নীতি আর অরাজকতা নিয়ে প্রতিবাদ হয়েই আসছে। এই প্রতিবাদ কি পেরেছে তার সমাধান দিতে? আসলে প্রতিবাদগুলো গঠনমূলক হয় না, তাই সমাজ এর ফল ভোগ করতে পারছে না। আর পারবেও না।
এসএমসি, স্কুল বিল্ডিং, মিডডে মিল ইত্যাদি প্রকল্পের আওতায় আসা সরকারি স্কুল-কলেজ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ রোজগার করা যায় কিনা আমরা সে পথটাই খুঁজি। আগে আমরা এসব মানসিকতা পরিহার করি, এরপর এই পথে হাঁটা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে সাড়াশি অভিযানে নামি। আমরা ভরসা করে স্কুল-কলেজে সন্তান পাঠিয়ে দেখি কাজের কাজ হয় কিনা। সরকারি শিক্ষকদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট স্কুল বর্জন করে সরকারি স্কুল-কলেজে আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করি, গণআন্দোলনের পথে পা মাড়াই। আমাদের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করার পর কিছু ফাঁকিবাজ প্রধান শিক্ষক যারা অফিস ম্যানেজ করে বুক ফুলিয়ে চলেন, সে সব সুবিধাবাদী শিক্ষক যারা নামমাত্র স্কুলে আসা-যাওয়া করেন, এদের শায়েস্তা করতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সম্মিলিত প্রতিবাদ আরম্ভ করি। সরকার যেহেতু শিক্ষা খাতে কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করছে, তথাপিও আমাদের হাজার হাজার টাকা ব্যয়ে ছেলেমেয়েদের অন্যত্র পড়ানো অদূরদর্শিতার পরিচয় বৈকি। আসুন, প্রাইভেট স্কুলগুলোর প্রতি লাগাম টানতে একযোগে আওয়াজ তুলি, এগুলোতে অঢেল অর্থ দেয়া বন্ধ করার চেষ্টা করি। হুজুগেই চলেছে এই সমাজ। গ্রামগঞ্জে বুদ্ধিজীবীদের অনুসরণ করেন আমজনতা। তাই প্রতি এলাকা থেকে শিক্ষিত, অর্থবলে বলীয়ান তিন-চারজন করে অভিভাবক এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেই একটা পরিবর্তন সম্ভব। প্রাইভেট স্কুলগুলোকে দেখে এদের শিক্ষাদান পদ্ধতি সরকারি স্কুলে আনয়ন করে বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করি। তবেই আসতে পারে সুদিন। ফিরতে পারে শিক্ষার হাল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষার মান উন্নয়নে, শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু একের পক্ষে এত বড় কাজগুলো সমাধান করা কি সম্ভব? এ ব্যাপারে আমাদের সকলকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সহযোগিতা করতে হবে। আর এসবের গভীরে না গিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে ফাঁকা ডঙ্কা বাজিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে দোষারোপ করলেই যে আখেরে কাজের কাজ হবে- এমন আসা করা যোক্তিক নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন