মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ও খাদ্য সংস্থান করতে গিয়ে দেশে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। গত আগস্টের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩৭ জেলায় পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তার কাজ ধীর হয়ে পড়েছে। সাধারণত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বন্যার্তরা সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে পড়ে। বাড়ি-ঘর, ফসল, গবাদি-পশু হারানোর পাশাপাশি কর্মহীন হয়ে পড়ে মানুষ। এ সময়ে তাদের পুনর্বাসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হলেও তার কার্যকর উদ্যোগ নেই বললেই চলে। বন্যা কবলিত এলাকার দিন মজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষগুলো নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছে। কোনো রকমে একবেলা খাবার জোগাড় করতে পারলেও আরেক বেলার খাবার জোগাড় করতে পারছে না। আয় না থাকায় অনেকে সহায়-সম্বল বিক্রি করে দিচ্ছে। অনেকে চড়া সুদে ধার করে চলছে। বীজের অভাবে কৃষক ফসল ফলাতে পারছে না। সাধারণত ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে উত্তরাঞ্চলের মানুষ অভাবে পড়ে। এ অভাব তীব্র করে তুলেছে বন্যা। এ সময়ে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করার কথা থাকলেও তা এখনো শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। যেসব কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, তা খুবই অপ্রতুল। আবার অনেক কর্মসূচি চালু করা হবে বলে বলা হচ্ছে। কবে চালু হবে, তা অনিশ্চিত। এক ধরনের দীর্ঘসূত্রিতা চলছে। এতে মানুষের দিন কাটছে চরম দুর্ভোগের মধ্যে। অথচ বন্যা কবলিত এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি ছিল। রোহিঙ্গাদের দিকে নজর দিতে গিয়ে বন্যা কবলিত এসব মানুষের কথা যেন ভুলে যাওয়া হয়েছে।
হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যায় প্রায় সমুদয় ফসল তলিয়ে যাওয়াসহ ব্যাপক ক্ষতির পরপরই উত্তর ও মধ্য অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে প্রায় পুরো উত্তরাঞ্চল বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। রাস্তা-ঘাট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৪ লাখ কিলোমিটার রাস্তা বন্যায় নষ্ট হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে সরকারসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের যেভাবে দাঁড়ানোর কথা, সেভাবে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ঢল সরকারসহ প্রায় সবার দৃষ্টি সেদিকে নিয়ে যায়। সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া বন্যাকবলিত মানুষগুলোর দুর্দশা চরমে উঠে। এখন পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানে জোরালো কোনো ভূমিকা নেই। এর সাথে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে চালসহ নিত্যপণ্যের আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। এর প্রভাব পড়েছে দেশের সর্বত্র। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপ প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, গ্রামের মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে। আয়ের সাথে ব্যয়ের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর-গ্রাম সর্বত্র সাধারণ মানুষ কষ্টের জীবনযাপন করছে। যাদের সঞ্চয় ছিল, তা ভেঙ্গে খরচ মেটাচ্ছে। ধার-কর্য করে ও দোকানে বাকিতে খাদ্যপণ্য কিনে কোনো রকমে দিন চালাচ্ছে। চাল, ডাল, তেল, শাক-সবজি সবকিছুর দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এ অবস্থার মধ্যেই গত মঙ্গলবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ১৪৬৫ ডলার থেকে বেড়ে ১৬১০ ডলার হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল এ তথ্য উপস্থাপন করেন। তবে এ পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতার কতটা মিল রয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়টি বরাবরই বিতর্কের ঘোরে আবর্তিত। সরকার একরকম বললে, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। মাথাপিছু আয়ের বিষয়টি অনেকটা শুভংকরের ফাঁকি হয়ে রয়েছে। প্রায় চার কোটি বেকারের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু বেকার নয়, হতদরিদ্র এবং খেটে খাওয়া ও দিন মজুরদের বিষয়টি বিবেচনা করলেও মাথাপিছু আয়ের হিসাবটি যথার্থ হয় না। এছাড়া এ সময়ে সাধারণ মানুষ যে টানাপড়েনের মধ্যে জীবনযাপন করছে, তার সাথে এ চিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থাকলেও, সীমিত আয়ের মানুষের আয় এক টাকাও বাড়েনি। এ প্রেক্ষিতে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মানুষ কী শোচনীয় অবস্থার মধ্যে আছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই।
আমাদের দেশে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক হিসেবে গ্রামীণ উন্নয়ন তথা গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মূল সূচক হিসেবে ধরা হয়। গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে, এমন একটি কথা প্রচলিত। বাস্তব চিত্র হচ্ছে, গ্রামীণ উন্নয়নের চাকা শ্লথ হয়ে পড়েছে। সেই সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষের জীবনমান অবনতির দিকে যাচ্ছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে যে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের গতি বৃদ্ধির বিকল্প নেই, তার চিত্রটি খুবই করুণ। বেসরকারি বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। বিনিয়োগের এ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠার আশু কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। স্বাভাবিক কারণেই বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষের আয়-রোজগারও কমে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক অস্থিরতা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। এর উপর রোহিঙ্গা সমস্যা এক বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যাকবলিত অসহায় মানুষের সহায়তার উপর ভাগ বসিয়েছে। আমাদের কথা হচ্ছে, রোহাঙ্গিাদের পাশে মানবিক কারণে দাঁড়ানোর পাশাপাশি দেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান। যেহেতু সরকার বলছে, জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, তার অর্থ হচ্ছে, সরকারের কাছে যথেষ্ট অর্থ রয়েছে। এ অর্থ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান এবং গ্রামীণ জনগণের দ্রুত উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন