সারাদেশের দুই কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যরে গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থাপনা স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে সারাদেশের ৬৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক মেরামত, সংস্কার ও তত্ত্বাবধান করবে উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি। যাতে উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন স্থানীয় এমপি এবং কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা।
এত দিন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নিয়ন্ত্রণেই ছিল এসব গ্রামীণ সড়কের ব্যবস্থাপনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে করে সড়ক সংস্কারে ঠিকাদার নিয়োগে থাকবে রাজনৈতিক প্রভাব। অতিরিক্ত ব্যয়ের পাশাপাশি কাজও হবে নিম্নমানের। এতে দুর্বল হবে স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়া গ্রামীণ সড়ক। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোঃ শহীদুল হাসান বলেন, এতে করে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি যেমন বাড়বে তেমনি কাজের গুণগত মানও কমে যাবে।
এর আগে সেকেন্ড রুরাল ট্রান্সপোর্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (আরটিআইপি) আওতায় পারফরম্যান্স বেজড মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট (পিবিএমসি) পদ্ধতিতে আট জেলায় এলজিইডির আওতাধীন ৪৩৮ কিলোমিটার সড়কের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছিল স্থানীয় ঠিকাদারদের হাতে। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম হওয়ায় প্রকল্পের দেড় কোটি টাকা ফেরত নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে দুই কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যরে গ্রামীণ সড়কগুলো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (এলজিআই) হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকারকে আরো শক্তিশালী করতেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গত ২৯ অক্টোবর এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে পরিকল্পনা কমিশন। প্রজ্ঞাপনে এলজিইডির অধীনে রয়েছে উপজেলা, ইউনিয়ন, টাইপ ‘এ’ ও টাইপ ‘বি’ (দুই কিলোমিটার বা এর বেশি দৈর্ঘ্যরে) শ্রেণির সড়কের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৮৯ হাজার ৭০টি। এসব সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৯ কিলোমিটার। দুই কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যরে টাইপ ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত ৬১ হাজার ৬০৮টি সড়ক এলজিআইয়ের অধীনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এসব সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৬৩ হাজার ২৪৪ কিলোমিটার। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এলজিআইয়ের অধীন এসব গ্রামীণ সড়ক সংস্কার ও তত্ত¡াবধান করবে উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি। যার উপদেষ্টা হবেন এমপি। কমিটির সভাপতি থাকবেন স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দের একটি অংশ ব্যয় হবে এসব সড়ক সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে।
গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষায়িত দক্ষতা আছে কেবল এলজিইডির। স্বাভাবিকভাবেই সংস্থাটিকে বাইরে রেখে গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন কার্যক্রম হলে গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থাকবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বুয়েটের পরামর্শে এলজিইডির একটি নীতিমালা রয়েছে, যার মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লে নেই। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে এ সংক্রান্ত কোনো বিশেষজ্ঞও নেই। তাই স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়ায় নিম্নমানের কাজ যেমন হবে, একইভাবে সরকারের ব্যয়ও বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণে এলজিইডির তদারকি ও অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। মানের বিষয়টি বিবেচনায় এসব গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নে এলজিইডিকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। তাদের দাবি, এলজিইডি ছাড়া দেশের কোনো উপজেলায়ই নিজস্ব অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ নেই। তা সত্তে¡ও এ কাজে এলজিইডিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এলজিইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, যদিও বলা হচ্ছে স্থানীয় সরকার এলজিইডির কারিগরি সহায়তা নিবে। তবে এতে করে জেলা নির্বাহী প্রকৌশলীদের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হবে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, এখন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় যে কাজগুলো হচ্ছে, সেগুলোও নিম্নমানের। গ্রামীণ সড়কের ক্ষেত্রেও এমনটা যাতে না হয়, সেজন্য এলজিইডিকে এতে সম্পৃক্ত করা যেতো। যদিও এটা নির্ভর করছে উপজেলা সমন্বয় কমিটির ওপর।
আলাপকালে এলজিইডি’র বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, রাজনৈতিক চাপে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের অভিযোগ অনেক পুরনো। এতে অর্থের যেমন অপচয় হয়, কাজের মানও ভালো হয় না। একই সাথে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। নতুন নিয়মে গ্রামীণ সড়কের কাজ পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক প্রভাবে হবে-এটাই স্বাভাবিক। এলজিইডিকে রাখলে কাজের মানটা অন্তত ভালো হতো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন