কালকিনি (মাদারীপুর) থেকে মো. ইকবাল হোসেন : আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসেছে ততই প্রকট হচ্ছে মাদারীপুর-৩ আসন (কালকিনি-ডাসার-মাদারীপুর সদরের একাংশ) আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির প্রেক্ষাপট। নির্বাচনকে সামনে রেখে আগে ভাগেই তৃণমূলের দলীয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখাসহ দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে চলমান বিভেদ নিরসনে চেষ্টা চালাচ্ছে উভয় দলই।
কালকিনিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির হালচাল : প্রায় ২২ বছর মাদারীপুর-৩ আসনে সংসদ সদস্য থাকার পরে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে উপজেলা নির্বাচন ও পৌর নির্বাচনে দলীয় সমর্থনের বিষয় নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মী সমর্থকদের সাথে চরম গ্রæপিংয়ে জড়িয়ে পড়েন। আর গ্রæপিং এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে, তা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অপরদিকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পদ্মাসেতুসহ বিভিন্ন ঝামেলায় নিপাতিত হন তিনি। আর সেই সময়ে কালকিনিতে এসে নিজেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেন বিরোধীরা গোলাপকে মাঠে সক্রিয় রাখতে তার সাথে একত্মতা ঘোষণা করে। আর গোলাপকে রুখতে আবুল হোসেনপন্থ’ীরা গোলাপের প্রচারণার গাড়িবহরে বোমা হামলা চালায়। এ নিয়ে উভয় পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি মামলাও করে। মাঠে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, গোলাপকে মনোনয়ন দিলে আবুল হোসেনপন্থীরা বিরোধিতা করবে এবং আবুল হোসেনকে মনোনয়ন দিলে গোলাপপন্থীরা বিরোধিতা করবে। এনিয়ে চরম বিপাকে ও দ্বিধাবিভক্ত তৃণমূল নেতাকর্মী-সমর্থকরা।
দলের এমন সমস্যার সুরাহার নিমিত্তে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে প্রথমে আবুল হোসেনপন্থ’ীরা বিদ্রোহ করলেও গ্রæপিংয়ের অন্যপিঠ ড. আবদুস সোবহান গোলাপপন্থীরা নাছিম মনোনয়ন পাওয়ায় আনন্দ মিছিল করে। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় প্রতিদ্ব›দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হন তিনি। আর কালকিনির রাজনীতিতে আবুল হোসেনের যেসব সেক্টরে শূন্যতা ছিল, তিনি সেই শূন্যতাই পূরণে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতে থাকলেন। তার মধ্যে প্রতি সপ্তাহ এবং মাসে দুই থেকে ২১ দিনের কর্মসূচি দিয়ে প্রতিটি পাড়া-মহল্লা ও ইউনিয়নে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন। রমজানে তার নির্বাচনি এলাকার পৌরসভাসহ ২১টি ইউনিয়নে পৃথকভাবে ২১ দিন ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে সেখানে উপস্থিত থেকে সাধারণ মানুষের সাথে ইফতার করেছেন। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে তাকে নিয়ে এক নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়। অপরদিকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন একইভাবে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ও সব সহযোগী অঙ্গসংগঠনের উপজেলা থেকে শুরু করে ওয়ার্ডপর্যায়ে সম্মেলনের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিদের পদে এনে দল ও দলীয় নেতাকর্মীদের চরমভাবে সক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছেন। আর নজিরবিহীন উন্নয়নের মাধ্যমে দলের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মন জয়েও অগ্রণী ভ‚মিকায় রয়েছেন। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সেক্টরে পিছিয়ে থাকা কালকিনিতে স্বাধীনতার পর থেকে যে উন্নয়ন হয়েছে, গত চার বছরে তার দ্বিগুণ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ-ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এই সেøাগানকে সামনে রেখে চরাঞ্চল ও অঁজোপাড়াগায়ে শত কোটি টাকা ব্যয়ে ঘরে ঘরে দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এতে একদিকে যেমনি সরকারের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে কালকিনির লাখ লাখ মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের । ঠিক একইভাবে নিজে কৃষিবিদ হওয়ায় কৃষির উন্নয়নেও একইভাবে অবদান রয়েছে তার। তৃণমূল নেতাকর্মীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হওয়ায় এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের কারণে বর্তমানে গ্রামগঞ্জে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচিসহ নেতাকর্মীরা দলীয় ফোরামে বক্তব্য দিলে সবাই ফের আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে মনোনয়ন দেয়ার সুপারিশ করেন এবং দলের হাইকমান্ডের প্রতি আহŸান জানান।
অপরদিকে সৈয়দ আবুল হোসেনের ২২ বছরের রাজত্বে কিছু কর্মী একনিষ্ঠ হয়ে যাওয়ায় তারা দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করলেও তারা মনে করেন, কালকিনির উন্নয়নের স্বার্থে আবুল হোসেনকে মনোনয়ন দিলে তিনি বিজয়ী হবেন।
এ ছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ তার নিজ গ্রাম রমজানপুরে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ডিজিটাল সেন্টার, ব্যাংকসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান করেও বেশ আলোচনায় রয়েছেন। তার সমর্থকদের মতে, তিনিও দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।
কালকিনি বিএনপির রাজনীতির হালচাল : কালকিনিতে স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বেশি সময় ক্ষমতায় থাকায় বিএনপির এখানে ক্ষমতার স্বাদে দল গোছাতে সক্ষম হয়নি। আর যা গুছিয়েছে তা একেক সময় একেক নেতার যোগ্যতার বিহিঃপ্রকাশ। তবে বর্তমানে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন দুইজন। তারা হলেনÑ কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান। মাঠে ঘাটে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নাম উঠলে এই দুই নেতার নামই আলোচনায় আসে।
তবে দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন বর্তমান সময়ে এগিয়ে রয়েছে। আর তার সক্রিয়তার কারণে আওয়ামী লীগ কর্মী যে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে তাতেও খোকন তালুকদার ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। কালকিনিতে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে তাও বিশেষ করে খোকন তালুকদারের কর্মীদের সাথেই হয়েছে। অপরদিকে দলীয় কর্মসূচি বলতে কালকিনিতে আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনের আগমন ও তার গণসংযোগকেই ধরে নিচ্ছে নেতাকর্মী সমর্থকরা। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তবে মাদারীপুর-৩ আসনে আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার দাবিতে দলীয় কর্মসূচিগুলোতে বক্তব্যের মাধ্যমে দাবি করেছেন মাদারীপুর জেলা বিএনপি মাদারীপুর সদর উপজেলা বিএনপি, কালকিনি উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাধারন সম্পাদকসহ সব সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
এ ছাড়াও কালকিনিতে অধ্যাপক সৈয়দ বেলায়েত হোসেনকে আগাম দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে তৃণমূলে জনসমর্থন পেতে কাজ করে যাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তবে মাঠ পর্যায়ে তাদের কর্মীবাহিনী ব্যাপক সক্রিয় থাকায় আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে তারা চরম আশাবাদী। এর আগে তারা পৌর ও ইউনিয়নগুলোতেও দলীয় প্রার্থী দিয়ে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে।
আরেকটি ব্যাপার হলো- এরশাদ সরকারের আমলে কালকিনিতে জাতীয় পাটির এমপি ও মন্ত্রী থাকলেও বর্তমানে দলটির কার্যক্রম কালকিনিতে বিলুপ্তি হয়ে গেছে। তৃণমূল থাক দূরের কথা, উপজেলা পর্যায়ে তাদের দলীয় সভাপতির ইন্তেকালের পরে আর দলটির নেতাকর্মী ও দলীয় কর্মসূচির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তৃণমূলে না থাকলেও উপজেলায় জাসদের কমিটি রয়েছে এবং তারা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন