ওরা দুইজন। সাংগঠনিকভাবে দেশের সর্ববৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি। একজন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছের মানুষ। অন্যজন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর; খালেদা জিয়ার পছন্দের ব্যক্তি। দুই শীর্ষ নেত্রীর কাছে নিত্য যাতায়াত করা দু’নেতাই এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি। সৈয়দপুর বিমানবন্দরে দুই নেতা কুশল বিনিময় করে মাত্র দুই মিনিট একত্রে ছিলেন। দূরদর্শি রাজনীতিকের মতোই একে অপরের খোঁজখবর নিয়েছেন। সেই দৃশ্য এবং দুই নেতার বক্তব্য নিয়ে চলছে সর্বত্রই ইতিবাচক আলোচনা। এ যেন রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ ভেদ ঠেলে দিয়ে এক পশলা রোদ্রের ঝিলিক।
দৈনিক পত্রিকা এবং টিভি মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দুই নেতার কুশল নিয়ে চলছে গল্প গুজব। বড় দুই দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার কুশল বিনিময়ের দৃশ্যকে অনেকেই ‘রাজনীতিতে সুবাতাস’ এর বার্তা দেখছেন। দীর্ঘ এক যুগ থেকে বৈরী রাজনীতির মাঠে দুই নেতার এই ‘কুশল বিনিময়’ কিছুটা হলেও প্রশান্তির বার্তা দিচ্ছে। দুই নেতাই এ জন্য অভিনন্দন পাচ্ছেন। অতীতে আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়া যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন; সময়ের বিবর্তনে এই দুই নেতা সেখানে সফল হবেন মানুষ এমন প্রত্যাশাই করছেন।
দেশের রাজনীতিতে কার্যত চলছে ‘কথার যুদ্ধ’। আদর্শ-দর্শন দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘাঁয়েল করা যেন হয়ে গেছে সুদূর পরাহত। প্রতিপক্ষের প্রতি কেউ কথার বোমা ছুড়লে অন্য পক্ষ্য নিক্ষেপ করেন কথার মিশাইল। আক্রমণাত্মক এই রাজনীতি চর্চায় দেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ‘বিরল ঘটনা’ হয়ে গেছে। এমনকি আগে সামাজিক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের হাসিঠাট্টার দৃশ্য দেখা গেলেও এখন সেটাও বিরল। মাঝে মাঝে বিদেশি দূতাবাসগুলোতে দুই দলের নেতাদের একত্রিত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও সে দৃশ্য পর্দার আড়ালে মানুষের দৃষ্টি সীমার বাইরে থাকে। ইদানীং পরিস্থিতি এতই নাজুক যে, রাষ্ট্রীয় এবং প্রতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানাদিতে ‘এ পক্ষ’ হাজির থাকলে ‘ও পক্ষ’ সে পথ মাড়ান না; আবার ‘ও পক্ষ’ উপস্থিত হলে ‘এ পক্ষ’ এড়িয়ে যান। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা গণতান্ত্রিক দেশ অথচ দুই প্রধান দলের নেতাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি কার্যত বন্ধ। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া একাধিকবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দুই নেতাই নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় আসেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে বৈঠক করেন। পর্দার আড়ালে হওয়া সে বৈঠক সফল হয়নি। কিন্তু দেশের মানুষ এখন প্রত্যাশা করছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই দুই নেতা সফল হবেন। তারা শুধু কুশল বিনিময়ের মধ্যেই থাকবেন না; আরো ভালো কিছু করে দেশবাসীকে দেখাবেন।
ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কুশল বিনিময় হয় গত রোববার সৈয়দপুর বিমানবন্দরে। রংপুরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সৈয়দপুর যান ওবায়দুল কাদের। একই দিন বিমানে করেই সাংগঠনিক সফরে রংপুর যান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকায় ফেরার সময় সন্ধ্যায় তাদের দেখা হয় সৈয়দপুর বিমানবন্দরে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লাউঞ্জে বসে ছিলেন। ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে প্রবেশের পর ওবায়দুল কাদের বিএনপি মহাসচিবকে দেখে সেদিকে ছুঁটে যান। স্বভাবসুলভ ভাবেই হাত বাড়িয়ে ‘ভাই কেমন আছেন?’ জবাবে স্মিত হেসে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন ভাই?’ হাত মেলান দুই নেতা। মিনিট দুয়েক কথাবার্তা। বিমান ছাড়ার সময় হওয়ায় ওবায়দুল কাদের বিদায় নিয়ে বলেন, ‘যাই বিমান রেডি হয়ে আছে।’ মির্জা ফখরুলও ‘ধন্যবাদ’ বলে ওবায়দুল কাদেরকে বিদায় জানান। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না কারামুক্তির পর হাসপাতালে ভর্তি হলে দুই নেতাই তাকে দেখতে যান। কিন্তু কারো সঙ্গে কারো দেখা হয়নি। ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তিনি এই প্রথম বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।
গণতন্ত্র মানেই পরমত সহিষ্ণুতা। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন ‘তোমার মতামতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাবো’। দার্শনিক ভলতেয়ারের এই উক্তি-চিন্তা হচ্ছে আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি। গণতন্ত্র নিয়ে প্রায় তিন শ’ বছর আগে ভলতেয়ার এই উক্তি করলেও আমরা কার্যত গণতন্ত্রকে স্রোতের বিপরীতে নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করছি। সংলাপের কপাট বন্ধ করে নিজেরাই অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি। রাজনীতিতে মতভেদ থাকবেই। বিজ্ঞজনেরা বলেন, নেতায় নেতায় মুখ দেখাদেখি এবং আলোচনার পথ খোলা রাখলে একে অপরের মনন বুঝতে সুবিধা হয়। নিজের মতামত প্রকাশ ও যুক্তি তুলে ধরা যায়; একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের যুক্তি খন্ডন করা যায়। আলোচনার কপাট বন্ধ থাকলে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস বাড়ে; সন্দেহের পাহাড় হয় পারদের মতো ঊর্ধ্বমুখী। এই সুযোগে দলের ভেতরে-বাইরের ষড়যন্ত্রকারীরা মতলব আঁটে; দলকে গণবিমুখ করে। ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঝানু রাজনীতিকের মতোই ‘কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে’ সেই বন্ধ কপাট যেন খুলে দিলেন।
দেশের রাজনীতি কার্যত দুই ধারায় বিভক্ত। এক ধারা জননেত্রী শেখ হাসিনা; অন্যধারা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ঘিরেই আবর্তিত। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেমন শেখ হাসিনার কাছে অনায়াশে যেতে পারেন; নেত্রীর কাছে নিজের মতামত এবং অন্যের মতামত তুলে ধরতে পারেন; তেমনি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সব সময় বেগম জিয়ার কাছাকাছি থাকেন; নিজের এবং দলের নেতাকর্মী সাধারণ মানুষের মনন চিন্তার কথা নেত্রীর সামনে তুলে ধরতে পারেন। পোড় খাওয়া রাজনীতিক হিসেবে দুই নেতাই ঝানু এবং নিজ নিজ দলের নেতাকর্মীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়; ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দূরদর্শী এবং পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হওয়ায় দলের বাইরেও দুজনই সাধারণ মানুষের কাছেও জনপ্রিয়। তারা দেশের আমজনতার মনন মানসিকতা বুঝেন এবং নিশ্চয়ই মানুষের মঙ্গল কামনা করেন। দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে ‘সম্পর্কের জমাট বাঁধা বরফ’ বিদ্যমান; দু-নেতাই উদ্যোগী হলে সে বরফ গলাতে পারেন। তারা ঘন ঘন একে অপরের সঙ্গে মতবিনিময় করলে রাজনীতির আকাশে অবিশ্বাস-সন্দেহ ও সঙ্কটের কালো মেঘ ক্রমান্বয়ে কেটে যাবে। দুই নেতা অবশ্যই জানেন শীর্ষ নেত্রীরা দলের সবার। কিন্তু দলের কিছু কিছু নেতা ব্যক্তিস্বার্থে দুই দলের মধ্যে বিরোধ বাঁধিয়ে নেত্রীদ্বয়ের কান ভারী করে দূরত্ব বাড়িয়েই দিচ্ছে। এতে ওইসব নেতা স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। দায়িত্বশীল দুই নেতা যে কুশল বিনিময়ের দৃশ্যের অবতারণা করলেন সেটা যেন অব্যাহত থাকে; দেশবাসী সে প্রত্যাশাই করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন