এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পর পর তিন দফায় নির্বাচিত হয়ে ১৭ বছর দায়িত্বে থাকা সাবেক সিটি মেয়র। তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের সর্বশেষ আলাপচারিতা হয় তিনি গত ১১ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার মাত্র কয়েকদিন আগে গত ৭ ও ৮ নভেম্বর। আলাপের শেষ পর্যায়ে দৈনিক ইনকিলাবের মাননীয় সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের কুশলাদি সম্পর্কেও যথারীতি জানতে চান। জানাই, তিনি ভালো আছেন। ওই দু’দিন আলাপচারিতায় জানার মূল বিষয়টি ছিল- বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ উপলক্ষে গত ২৮ থেকে ৩১ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ফের কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়কপথে সফরের চার দিনের কর্মসূচিকে ঘিরে যে অঘোষিত শোডাউন সম্পন্ন হয়েছে তাতে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করছেন। জবাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, ‘তোমার সাথে এমনিতেই কথাবার্তা বলবো। তবে এবার লিখিও না। একটু অসুস্থ তো। তাই কখন কী উল্টাপাল্টা বলে ফেলি। তাতে আমার সরল কথাগুলো কে আবার কোনদিকে ঘুরিয়ে ফেলে। কেউ মনে কষ্টও পেতে পারে’। রাজি হয়ে যাই। কথাও হয় ঢের। তাছাড়া ওই বিষয়েই আরও কথা হয় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত নুরুল আলম চৌধুুরীর সাথেও এবং তার ‘অফ দ্য রেকর্ড’ কথাগুলো শুনে রাখি এবং ‘অন রেকর্ড’ বক্তব্যগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আলাদা করে পরিচয় ও বিশেষণে ভূষিত না করলেও সমগ্র দেশের মানুষের কাছে পরিচিত একটি নাম আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামবাসীর তাকে দেওয়া উপাধিটি হচ্ছে ‘চট্টলবীর’। বিগত ১১ নভেম্বর তিনি বাসায় হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রাতেই তাকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় পরদিন ১২ নভেম্বর তাকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কিছুটা উন্নতি হলে চিকিৎসকদের পরামর্শে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ১৫ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি হৃদরোগ, ডায়বেটিস ও কিডনির জটিলতায় ভুগছেন দীর্ঘদিন যাবত। সিঙ্গাপুরে তাকে অস্ত্রোপচার করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সঙ্গে আছেন তার পুত্র ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য।
এদিকে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে রাজনীতিতে যে সৌজন্য ও সৌন্দর্য অতীত থেকেই রেওয়াজী ধারার মতোই চলে আসছে তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। দল-মত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদে-আপদে, জানাযায়, নিজ হাতে লাশের কাফন-দাফন এবং বিয়ে-শাদিতেও সবার আগেই তাকে ছুটে যেতে দেখা যায়। তিনি গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও চট্টগ্রামের রাজনীতির সৌন্দর্যবোধ ফুটে উঠেছে পুনরায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময়ে এবং দেখার জন্য এ পর্যন্ত ছুটে গেছেন চট্টগ্রামের নেতা অনেকেই। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে তাকে দেখতে গেছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা নুরুল ইসলাম বিএসসি। ঢাকায় ও চট্টগ্রামের হাসপাতালে দেখতে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ অনেকেই। শুধুই তাই নয়; মহিউদ্দিন চৌধুরী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এ যাবত চাটগাঁর সর্বস্তরের মানুষ তার শারীরিক অবস্থার প্রতিনিয়তই খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, দোয়া করছেন আশু সুস্থতার জন্য। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক ছাড়াও বিপরীত মেরুর বিএনপির কর্মীরাও তার সুস্থতা কামনা করছেন। তার হঠাৎ গুরুতর অসুস্থতায় প্রকাশ করে চলেছেন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এখানে-সেখানে সাধারণ মানুষের মাঝে আলাপচারিতায় ও আলোচনায় উঠে আসছে তার অসুস্থতার বিষয়টি। মানুষ কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছেন তার আরোগ্যলাভের জন্য। এর মধ্যদিয়েই মহিউদ্দিন চৌধুরীর পাহাড়সম জনপ্রিয়তার দিকটি সুস্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। চাটগাঁর একজন ‘পপুলার লীডার’ বা জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তার আসনটি তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
দেশের রাজনীতির ময়দানে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেও চট্টগ্রামে ভিন্ন পরিবেশ চোখে পড়ার মতোই। দুই প্রতিপক্ষের সিনিয়র ও মধ্যম সারির নেতাদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্ক ‘উষ্ণ’ ও ‘মধুর’। চাটগাঁবাসী তা জানেন। মউ (মামা)-ভাগিনা, চাচা-ভাতিজা, বেয়াই, শ্যালক-দুলাভাই, ওস্তাদ-শিষ্য, তালতো ভাই এ ধরনের সম্বোধন চট্টগ্রামের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাঝে বহুল প্রচলিত আছে। দেখাদেখি হলেই খুনসুটি মশ্করা করে আড্ডা জমিয়ে তোলেন নেতারা। সময়ে-অসময়ে একজন আরেকজনের বাসা-বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। ড্রয়িং রুম মাতিয়ে তোলেন। খাবার টেবিলে নিয়ে গিয়ে আদর আপ্যায়ন করান। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদের খোঁজ-খবর নেন পরস্পরের। চট্টগ্রামে রাজনীতিবিদ মরহুম একেএম ফজলুল কাদের চৌধুরী, মরহুম এমএ আজিজ, মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, মরহুম ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী, মরহুম সেকান্দর হোসেন মিয়ার মতো এককালের বাঘা বাঘা নেতা থেকে শুরু করে সেই সুদূর অতীতকাল থেকেই চাটগাঁর রাজনীতিকদের মিলেমিশে থাকার ইতিবাচক এই ধারা বা সৌজন্য রেওয়াজ কম-বেশি চলে আসছে। বিপরীতমুখী রাজনৈতিক বিশ্বাসে যে যার অবস্থান বজায় রেখেই এ ধরনের সুসম্পর্ককে দীর্ঘকাল যাবত চট্টগ্রামের রাজনীতির সৌন্দর্য হিসেবেই সবাই প্রশংসার চোখে দেখেন। সবাই মনে করেন এটি অশান্ত ও অসহিষ্ণু রাজনীতিতে সুবাতাস।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর আকস্মিক গুরুতর অসুস্থতার পর থেকে গত দিনগুলোতে সর্বস্তরের চট্টগ্রামবাসীর মাঝে তার দ্রুত আরোগ্যের জন্য দোয়া-প্রার্থনা ও আকুল ইচ্ছার কথাগুলোই উচ্চারিত হচ্ছে বার বার। সবাই বলছেন, চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরী সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে হাসিমুখে আবার ফিরে এসো। কেননা তুমি সুখে-দুঃখে চট্টগ্রামবাসীর দরদী অভিভাবক আছো- তুমি আমাদের মাঝে দীর্ঘজীবি থেকো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন