শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

প্রাথমিকেও প্রশ্নপত্র ফাঁস

| প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাসমাপনী পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত ঘটনায় পর্যবসিত হলেও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা আগে শোনা যায়নি। প্রাথমিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মধ্য দিয়ে এ ক্ষেত্রে ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। সেই সাথে এবার প্রশ্নপত্রে প্রচুর ভুলভ্রান্তিও ধরা পড়েছে। উল্লেখ্য, এবার দেশব্যাপী ৭ হাজার ২৬৭টি এবং বিদেশে ১২টি কেন্দ্রে গত ১৯ নভেম্বর থেকে প্রায় একত্রিশ লাখ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ী পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের কথা থাকলেও পরীক্ষার প্রথম দিনই প্রায় দেড়লাখ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। এমনিতেই এ বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল গত বছরের চেয়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার কম। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৩০ হাজার ২৮৮জন। এসব তথ্য উপাত্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে, একদিকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে, অন্যদিকে পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন ও ফরম ফিলাপ করার পরও অনুপস্থিতির হার বা ঝরে পড়া বেড়েছে। শিক্ষার্থীর জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার শুরু থেকেই একটি বিতর্কিত অবস্থান তৈরী করেছে। দেশের শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ এই পরীক্ষার আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সে প্রশ্নও তুলেছেন। প্রাথমিক শিক্ষায় অবহেলিত ও অনগ্রসর গ্রামীন বিদ্যালয়গুলোকে এক ধরনের জবাবদিহিতায় আনার জন্য এই পরীক্ষার গুরুত্ব থাকলেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে শিক্ষার্থীদের মেধাযাচাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে এই পরীক্ষাকে ঘিরে শিশুদের নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত কিন্ডারগার্টেন ও তথাকথিত নামিদামি স্কুলগুলোর ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, গাইডবই ও নোটবই বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা ও মুনাফাবাজি চলছে যা সমাজে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ ্এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা, একশ্রেনীর শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, ছাত্রনেতা-শিক্ষকনেতা এবং একশ্রেনীর অভিভাবক জড়িয়ে পড়েছেন।
যদিও পাবলিক পরীক্ষায় নকলবাজি এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোন নতুন উপসর্গ নয়। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাবলিক পরীক্ষায় নকলবাজি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও বর্তমানে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সমন্বিতভাবে অসদোপায় অবলম্বনের মাত্রা যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। প্রাথমিক সমাপনী(পিএসসি/ইবতেদায়ী), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও জুনিয়র দাখিল (জেএসসি-জেডিসি), মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট(এসএসসি) ও দাখিল এবং উচ্চমাধ্যমিক বা এইচএসসি(আলিম) পর্যন্ত প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষাই প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকলবাজি এবং যেনতেন প্রকারে উচ্চনম্বরসহ পাস করিয়ে দেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারী সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঘটছে। অতিরিক্ত ও কার্যত অপ্রয়োজনীয় পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদেরকে ঘন ঘন অহেতুক চাপের মুখে ঠেলে দিলেও প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানাবিধ অসদোপায়ের কারণে এসব পরীক্ষায় প্রকৃত অর্থে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ নেই বললেও চলে। এ কারণেই দেশের শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা নানামাত্রিক নেতিবাচক দিকগুলোকে সামনে এনে এসব পাবলিক পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, অধিক পরীক্ষার কারণেই প্রশ্ন ফাঁসে উৎসাহ বা সুযোগ বেড়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং প্রশ্নপত্রে অজ¯্র ভুলের যে সব অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রনালয় ও শিক্ষার্বোডও তার দায় এড়াতে পারেনা বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
গতকাল একটি সহযোগি দৈনিকে প্রকাশিত একটি শীর্ষ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘প্রশ্ন ফাঁসের বাজার’। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি এবং পাবলিক সার্ভিসের পরীক্ষা পর্যন্ত এই কালোবাজারের বিস্তৃতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই নিয়ন্ত্রণ করছে বলে সিআইডি সুত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে। সম্প্রতিক এ চক্রের কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস,শিক্ষাক্রম ও পাবলিক পরীক্ষার বাণিজ্যিকায়ণ শুধু শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই ব্যহতই করছেনা, সেই সাথে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতিসহ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষনা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমানের মতে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধারাবাহিক বাস্তবতায় বইয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বাড়ছে। যে পরীক্ষাব্যবস্থা পাঠ্য বইয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বাড়ায় সে পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উচ্চশিক্ষার স্তরবিন্যাস ও বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজনে পাবলিক পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে প্রশ্ন ফাঁসের মধ্য দিয়ে ডাক্তারী পড়া ও পাসের সুযোগ পাওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগী মরনাপন্ন বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় রডের বদলে বাঁশ ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাগিদ বলেছেন, মাদরাসা শিক্ষিতরা ইঞ্জিনিয়ার হলে তার রডের বদলে বাঁশ দিবেননা। একই সাথে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই ধারা অব্যহত থাকলে একসময় মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীরাও এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। সত্যিকার অর্থে সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করা সম্ভব হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গতানুগতিক ধারা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যেত। প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রশ্নপত্রে অস্বাভাবিক ভুলভ্রান্তিসহ সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় যে বিশৃঙ্খলা ও আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে তা থেকে উত্তরণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশেষত: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্যসহ শিক্ষাবাণিজ্য ও বৈষম্য নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
MD Solaiman ২৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:০১ এএম says : 0
হায়রে বাংলাদেশ! !!!!!
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন