কুমিল্লার রাজগঞ্জে রাজা নেই, রানীর বাজারে নেই রানী, মোগলটুলিতে মোগল নেই, জামতলায় জামগাছ নেই, ঝাউতলায় ঝাউগাছ নেই, আবার বাদুরতলায় নেই বাদুড়। প্রাচীন শহর কুমিল্লায় রাজা-রানী আর মোগল প্রেক্ষাপট বিলীন হলেও বাদুড়ের অস্তিত্ব কিন্তু রয়ে গেছে। জনশ্রæতি রয়েছে একসময় কুমিল্লা শহরের বাদুরতলায় অসংখ্য বাদুড়ের বসবাস ছিল। আর তাই এলাকাটির নাম বাদুরতলা হয়েছে। কখন থেকে বাদুরতলায় বাদুড় নেই এটির সঠিক দিনক্ষণ কারোরই জানা নেই। তবে শহরের সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণের গাছ-গাছালিতে বাদুড়ের আগমন ও স্থায়ী বসবাস কখন শুরু হয়েছে তারও সঠিক সময় বলা মুশকিল। তবে জনশ্রæতি রয়েছে বাদুরতলার বাদুড়ই নাকি সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গনে ঠাঁই নিয়েছে। শহুরে লোকালয়ে বাদুড়ের বসবাসের চিত্র আর গোধূলি লগ্নে ওদের কিচমিচ শব্দে পথচারি ও আশপাশের মানুষজন মুহূর্তের জন্য হলেও কুমিল্লা সার্কিট হাউজের গাছ-গাছালির দিকে গলা উঁচু করে দৃষ্টি ফেলেন। বংশপরম্পরায় বাস করা সার্কিট হাউজের বাদুড়রা ধরে রেখেছে বাদুরতলা নামের ঐতিহ্য।
কুমিল্লা শহরের প্রবীণ লোকদের কাছ থেকে জানা যায়, একসময় শহরের বাদুরতলা এলাকায় গাছে গাছে অসংখ্য বাদুড় বাস করতো। পরে স্থানান্তর হয়ে এসব বাদুড় ষ্টেডিয়াম রোডের দু’পাশে বড় বড় গাছে, পার্কের বড় ঝাউগাছে, পুলিশ সুপারের বাড়ীর গাছে এবং সার্কিট হাউজের ভেতরের পশ্চিম ও পেছনের দিকের বিভিন্ন গাছের ডাল-পালায় আশ্রয় নেয়। ধীরে ধীরে নিরিবিলি স্থান হিসেবে বাদুড়ের পছন্দের জায়গাটি সার্কিট হাউজের গাছ-গাছালিতে গিয়ে ঠেকে। শহরের ৮০/৯০ বছর বয়সী লোকজন জানান, তারা কিশোর বয়সেই সার্কিট হাউজ, ষ্টেডিয়াম এলাকার গাছে গাছে অসংখ্য বাদুড় দেখেছেন। এসব বাদুর তাদের জন্মের আগেই এখানে বসবাস করছে। প্রবীণ লোকদের কথা থেকেই ধারণা করা হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে সার্কিট হাউজের গাছে গাছে বসবাস করে আসছে অসংখ্য বাদুড়। সার্কিট হাউজের মোগলটুলি ও কান্দিরপাড়মুখি রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত শত শত যানবাহন, হাজারো মানুষের চলাচল রয়েছে। এতো কোলাহলের ভিড়েও বাদুড়ের দল একটু অস্বস্তি বোধ করেনা। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে বাদুড় সাধারণত নির্জনতা পছন্দ করে। কিন্তু কুমিল্লা শহরের সার্কিট হাইজ এলাকায় বসবাস করা বাদুড়রা যেনো এখানকার মানুষের পরম ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বাস করতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পরই সার্কিট হাউজের গাছ-গাছালি ছেড়ে বাদুড়রা কিচমিচ শব্দ করে দলে দলে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে যায় খাবারের খোঁজে। আবার রাত শেষে ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই এরা ফিরে আসে কয়েক যুগের চিরচেনা সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গনে।
বাদুড় নিজের খাদ্য যোগানো ছাড়া মানুষের কোনোরকম ক্ষতি করেনা। বরং পরাগায়ণের মাধ্যম হিসেবে বাদুড় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাদুড় কীটপতঙ্গ খেয়ে এগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফসল রক্ষা করে। অথচ বাদুর সম্মন্ধে এখনো আমাদের সমাজে মানুষের মধ্যে নানরকম ভুল ধারণা জন্মে আছে। অনেকেই মনে করেন বাদুড় ঘরে প্রবেশ করা নাকি অশুভ লক্ষণ। এটা সত্যি নয়। মানুষের মধ্যে যে স্বার্থপর ভাব রয়েছে তা বাদুড়ের মধ্যে নেই। মানুষ মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নিতে দ্বিধা করেনা, কিন্তু বাদুড় এক অন্যের সাথে খাবার ভাগাভাগি করে খায়। কুমিল্লা শহরে বাদুড়রা বংশপরম্পরায় বসবাস করছে। নির্জন পাহাড়, গুহা, বনে-জঙ্গলে থাকার এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি শহরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কুমিল্লা শহর এখন বাদুড়দের অনেক চেনা জানা হয়ে ওঠেছে। তাইতো সার্কিট হাউজ ও ষ্টেডিয়াম সড়কে দিনের বেলায় মিছিল, কোলাহল, মানুষের হৈহুল্লুর, যানবাহনের হর্ণের আওয়াজেও ঘুমিয়ে থাকা বাদুড়দের সমস্যা হয়না। শহরের প্রবীণ ব্যক্তিরা মনে করেন বাদুরতলায় বাদুড় না থাকলেও সার্কিট হাউজে বাদুড়ের দীর্ঘ কয়েক যুগের বসবাস বাদুরতলা নামটিকে সমুজ্জ্বল রেখেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন