শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

উন্নয়নের মহাসড়কে গণতন্ত্র কোথায়

প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুর্শিদা খানম
উন্নয়ন’ বা ‘উন্নয়ন ভাবনা’ প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধ্যান-ধারণার পরিসর ছেড়ে ব্যাপক ও বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে অনেকদিন আগেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোর নানাবিধ সমস্যা সমাধানে পূর্ববর্তী উন্নয়ন প্রয়াস সীমিত ও অপর্যাপ্ত হওয়ার নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আরও প্রসারিত হয়েছে। শুধু আয় বৃদ্ধি নয়, মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সমাজ ও জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিক সর্বশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
প্রাচীন প্রস্তর যুগে হাতিয়ার তৈরি মানুষের খাদ্য আহরণ ছিল একধরনের উন্নয়ন যা পরবর্তীতে কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন অব্যাহত থেকেছে। উৎপাদনের পাশাপাশি আরো একটি শব্দ যুগপৎ স্থান করে নিয়েছিল তা হচ্ছে সভ্যতা। সভ্যতার ধারায় আদিম দাস সামন্ততন্ত্র থেকে রূপান্তরিত হয়েছে পুঁজিবাদ। পরিবর্তনের ধারায় গড়ে উঠেছে প্রথা, প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ বিজ্ঞান চেতনা। মানুষ নির্মাণ করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও ইতিহাস, সংরক্ষণ করেছে ঐতিহ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হতে থাকে। আর এই সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল উন্নয়ন। সে সময় বিশ্বে দুটো আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ছিল। একটি হলো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অন্যটি পুঁজিবাদী। বিশ্ব স্পষ্টভাবে দুটো রাজনৈতিক বলয়ে বিভক্ত ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই সমাজতন্ত্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছিল যা ছিল বিস্ময়কর। আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী দেশগুলোও পিছিয়ে ছিল না। স্বাধীন দেশগুলোর সামনে তারা তুলে ধরল আধুনিকীকরণের মডেল। তাদের মডেল অনুযায়ী আধুনিকীকরণ অর্থই হচ্ছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে অনুকরণ, আধুনিক হতে হবে উৎপাদনে, কৃষি, শিল্প-বাণিজ্যে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও হতে হবে আধুনিক। আশির দশকে সংকটগ্রস্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। দুই ধারায় বিভক্ত বিশ্ব ব্যবস্থা, দুই পরাশক্তির অস্ত্র প্রতিযোগিতা, একটি স্থায়ী সমস্যামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যার ফলে জীবনমানের কিছুটা উন্নয়ন হলেও প্রকৃত পক্ষে উন্নয়ন বিচারে মানুষ খুব একটা এগুতে পারেনি। তবে, দুই পরাশক্তির উন্নয়নকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে মানুষ উন্নয়নের নানা সমস্যা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল। যা নতুন নতুন চাহিদা ও উন্নয়ন ধারণার সাথে যুক্ত হয়েছিল।
সত্তরের দশকে জনকেন্দ্রিক উন্নয়ন (চবড়ঢ়ষবং পবহঃবৎবফ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ), মৌলিক চাহিদাভিত্তিক (ইধংরপ হববফ ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয), জীবনভিত্তিক উন্নয়ন (খরভব পবহঃবৎবফ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ), ও মানবিক উন্নয়ন (ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ) ইত্যাদি বিকাশ লাভ করেছে। আশির দশক থেকে উন্নয়ন ধারণায় সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন প্রক্রিয়াযুক্ত হয়েছে এবং মানুষের প্রত্যাশার প্রশ্নটি গুরুত্ব পেয়েছে। তাতে মানুষের সক্ষমতার পূর্ণতর বিকাশ ঘটানোর প্রক্রিযা গড়ে তোলা এবং সমাজ ও সংস্কৃতির স্থানীয় সম্ভাবনার উদ্দমশীলতায় উত্তরণ আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আশির দশকের সূত্র ধরেই নব্বইয়ের দশকে উন্নয়ন মানব প্রসঙ্গ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হতে শুরু করে। এ দশকের সূচনায় ইউএনডিপি সর্বপ্রথম মানুষের উন্নয়নকে উন্নয়নের পরিচয়বাহীরূপে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়। অর্থাৎ ১৯৯০ সাল থেকেই জাতিসংঘ অধিভুক্ত দেশের মানব উন্নয়ন সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। খুব উঁচু মানব উন্নয়ন, উঁচু মানব উন্নয়ন, মধ্যম মানব উন্নয়ন ও নি¤œ মানব উন্নয়ন এই চারভাগে মানব উন্নয়নকে শ্রেণি বিন্যাস করছে ইউএনডিপি, যা মানব উন্নয়ন সূচক নামে পরিচিত। ফলে মানব উন্নয়ন রিপোর্টে জাতিসংঘ অধিভুক্ত বিভিন্ন দেশের মানব উন্নয়নের অবস্থা জানা যায়। ১৯৯৩ সালে ধারণাটিকে আরও অর্থবহ করে বলা হয়। ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ রং ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব. অর্থাৎ তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সামাজিক অবস্থা উন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে এটা হবে জনগণের উন্নয়ন; সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথ বিকেন্দ্রীকৃত ও অংশগ্রহণমূলক কাঠামো গঠনের মাধ্যমে হবে জনগণের দ্বারা উন্নয়ন এবং শেষত প্রত্যেকটি চাহিদা পূরণ ও তাদের সবার জন্য সুযোগের ব্যবস্থা দিয়ে এটা হবে জনগণের উন্নয়ন। সুতরাং বলা যায়, উন্নয়ন ধারণায় এখন ‘মানুষ’ ও তার সমাজ বলা যায় মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে এসেছে। মানুষের উন্নয়ন তার সক্ষমতা বা সামর্থ্যরে বিকাশের মধ্যেই আসে। এরূপ বিকাশের পরিসীমার বিস্তার ও অর্জিত ক্ষমতার ব্যবহার ঘটে সমাজ ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধার সদ্বব্যবহার ও সু-অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার মধ্যে।
নোবলে বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্যসেনের মতে জনসাধারণের সক্ষমতার বিকাশই উন্নয়ন। মানুষের সক্ষমতা নির্ভর করে স্বত্বাধিকারের উপর অর্থাৎ কী পরিমাণ দ্রব্য এবং সেবা সামগ্রীতে সে তার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তার উপর। অমর্ত্যসেনের সক্ষমতার ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। যাই হোক, উন্নয়ন শব্দের সর্বজন গ্রাহ্য কোন সহজ ও সাধারণ সংজ্ঞায় আজ অবধি যাওয়া যায়নি বলেই মনে হয়। সে জন্য একেক চিন্তাবিদের কাছে উন্নয়ন এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এটি শুধু একটি অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা নয়, বরং মানসিক সমস্যাও বটে। যেমন, অর্থনীতিবিদগণ দাবি করেন যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক হলো, মাথাপিছু আয় এবং মোট জাতীয় আয়ের বণ্টন বা পরিমাণ। রাজনীতিবিদগণ মনে করেন, যে সমাজে মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তাসহ রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিদ্যমান সে সমাজই উন্নত। আচরণবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নই হলো আসল উন্নয়ন, যেখানে মানুষের উন্নতির সুযোগ রয়েছে। যত ভিন্ন ভিন্ন মতই থাকুক না কেন বিশ্বের সকল মানুষই চায় জীবনমানের ইতিবাচক পরিবর্তন। উন্নয়নকামিতা মানুষের ধর্ম। উন্নয়নকে ঘিরেই মানুষের যাবতীয় উদ্যম, পরিশ্রম ও কর্মতৎপরতা। পৃথিবীর ধনী ও দরিদ্র সকল দেশের মানুষের মুখে এখন একমাত্র শ্লোগান ‘আমরা উন্নয়ন চাই’।
দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। এদেশের মানুষও এ শ্লোগানের বাইরে নয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও মানব উন্নয়নসহ সকল প্রকার বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এদেশের অর্জনও কম নয়। জাতিসংঘ সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের অনেক সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। রেমিট্যান্স, গার্মেন্টস, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, সমুদ্র সীমানা, স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। সম্প্রতি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আত্মবিশ্বাস ও দেশপ্রেমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার জন্য সরকারের আহ্বান ও দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন আশার সঞ্চার করছে মানুষের মধ্যে। দেশের এই উন্নয়ন ধারা অব্যাহত থাকুকÑএটা সকলেরই প্রত্যাশা। কিন্তু প্রশ্ন আসছে, এত উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় কেন স্বস্তিতে নেই মানুষ? কেন আশায় বুক বেঁধেও মানুষ স্বস্তি খুঁজে ফেরে বারবার। সরকারের সেদিক নজর দেয়া উচিত।
গণতন্ত্রের দ্বার রুদ্ধ করে শুধু উন্নয়ন দিয়ে গণমানুষের মন রক্ষা করা যায় না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এহেন পরিস্থিতি উপলব্ধি করার সময় এখন। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর বিশেষত পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সারাবিশ্বের উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যাকে বলা হয়, পূর্ব এশিয়া মিরাকল। গত তিন দশক আগেও সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের অর্থনীতি বাংলাদেশের মতই ছিল, গণতন্ত্রের যাত্রা সুগম ছিল না। তবে, তারা সুশাসন, দুর্নীতিরোধ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। সুশাসন গণতন্ত্রকে সঞ্জীবনী দান করা। কারণ, সুশাসন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। অন্যদিকে, সুশাসন, ন্যায়বিচার, গণঅংশগ্রহণের অভাব জাতির মধ্যে হতাশা, অসন্তোষ, ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে কোন সময় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে যা অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে নানাভাবে। উন্নয়ন হয় বাধাগ্রস্ত। আমাদের দেশ যখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে কাজ করছে, তখন গণতন্ত্র, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বারবার। এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশে সরকার, সরকারি প্রশাসন, সরকারি দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অবস্থানগত বৈপরীত্য লক্ষণীয়। নেই কোন জাতীয় ঐক্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা, সহনশীল সহাবস্থান। মিডিয়ার বদৌলতে বেরিয়ে আসছে লুণ্ঠনমূলক অর্থনীতি, ব্যাংক লুট, দখলদারী ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান(দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন)গুলোর ক্ষমতা সংকোচনের নানাচিত্র ও অভিযোগ। সুশাসনের অভাবে এখানে গণতন্ত্র বড়ই দুর্বল। উন্নয়নের মহাসড়কে গণতন্ত্রের এ ধরনের খুঁড়িয়ে পথ চলা কোনভাবেই কাম্য নয়। গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসন। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। আর এই জনগণের জন্য সরকারের সকল উন্নয়ন ভাবনাও আবর্তিত। তাই উন্নয়নের মহাসড়কে গণতন্ত্রের (জনগণের শাসন) উন্নয়ন হওয়া দরকার সর্বাগ্রে। তবেই গণমানুষের অবাধ অংশগ্রহণ এবং ভালোবাসায় সিক্ত হবে জাতীয় রাজনীতি। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দেশপ্রেম ও ত্যাগী মনোভাব ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের উন্নয়ন হোক। সরকার এবং সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মকা-ের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ও স্বস্তি প্রতিষ্ঠিত হোকÑএটাই এখন সময়ের দাবি।
ষ লেখক : পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন