নুরুল আলম বাকু
ভেজাল ও বিষাক্ত শিশুখাদ্যে সারাদেশের হাটবাজার সয়লাব হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত এসব খাবার খেয়ে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে নানাবিধ রোগে। দীর্ঘদিন থেকে বড় বড় শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ছোট-বড় সব দোকানেই অবাধে এসব ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের বেচাকেনা চলতে থাকলেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এলাকার শিশুস্বাস্থ্য। মায়ের উদর থেকে একজন শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে তার উপর মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এই পাঁচটি মৌলিক অধিকার বর্তায়। তার মধ্যে সুষম ও ভেজালমুক্ত খাদ্য হলো সর্বপ্রথম ও অন্যতম মৌলিক অধিকার। আজ নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে সদ্যভূমিষ্ট শিশুটি প্রথমেই তার সর্বপ্রথম অধিকার সুষম ও ভেজালমুক্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভেজাল, নকল ও বিষাক্ত খাবারে সারাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে। একজন শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে তাকে তার মায়ের বুকের দুধ দেওয়া হচ্ছে। যে মা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যত খাবার খায় তার বেশিরভাগই ভেজাল ও বিষাক্ত। আর এসব কুখাদ্য খাওয়ার ফলে মায়ের দুধও হয়ে উঠছে বিষাক্ত। তাই নিরুপায় হয়েই সেই মা তার আদরের সন্তানের মুখে তুলে দিচ্ছে বিষাক্ত খাবার।
এমনকি ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের কারণে মায়ের পেটে থাকতে ভ্রƒণেরও এ বিষ থেকে রক্ষা নেই। মায়ের খাদ্যের মধ্যে থাকা বিষ ভ্রƒণের মস্তিষ্ক ও শরীরের গঠনে মারাত্মক বিঘœ ঘটায়। এসব শিশু শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মাতে পারে। অথচ এসব শিশুই আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিক। এসব শিশু একটু বড় হয়ে দুধের সাথে আস্তে আস্তে অন্য খাবার খাওয়া শিখছে। আর প্রথম থেকেই নানা ধরনের জুস, বিস্কুট, চকলেট, লজেন্স, চিপস্সহ নানারকম বিষাক্ত কেমিক্যাল ও কৃত্রিম রঙ দেওয়া খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। সেকারিন ও হাইড্রজের মত দ্রব্য মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে বিস্কুট, পাউরুটি, আইসক্রিম, কেকসহ ফাস্টফুডের নানা আইটেম। সারাদেশের স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে দেদার বিক্রি হচ্ছে এসব খাবার। আর এসব ভেজাল খাদ্যের প্রতি শিশুদের আকৃষ্ট করতে লজেন্স, চুইংগাম, চকোলেট, আচার, ড্রিংকস্, চিপস্ ইত্যাদির সাথে ফ্রি হিসাবে দেওয়া হচ্ছে বাঁশি, খেলনা, লটারির টিকিট, কুপন, প্লাস্টিকের স্পাইডারম্যান, ডোরেমন, সুপারম্যানসহ নানা ধরনের ছোট ছোট পুতুল, বিভিন্ন ধরনের স্টিকার। ফলে এসবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কোমলমতি শিশুরা ভেজাল খাবার খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ অকাল মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের নামি-দামি দোকান এমন কি চা ও পানের দোকানেও এসব বিক্রি হচ্ছে।
শিশুখাদ্য বিশেষ করে আইসক্রিম ও বেকারিতে তৈরি খাদ্যসামগ্রীতে যে রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। দামুড়হুদায় প্রকাশ্যেই দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ চলছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সরকারি অনুমোদনহীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেকারিন, চিনি, ময়দা, তেল, বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম রঙ, কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে তৈরি এসব খাদ্য নানারকম বাহারি নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। পানির সাথে সেকারিন, ফ্লেভার ও কৃত্রিম রঙ মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নানারকম পানীয়। রঙিন প্লাস্টিক ও পলিথিনের টিউবে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। দোকানীরা ফ্রিজে রেখে ঠা-া করে মিরিন্ডা, সেভেন আপ, পেপসি এবং আম, কমলা, লিচুসহ নানারকম ফলের জুস ইত্যাদি নামে বিক্রি করছে। উপজেলার হাটবাজার থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন দোকানে অবাধে প্রকাশ্যেই এসব বিক্রি হচ্ছে। আর অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি সস্তা দরের এসব ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার খেয়ে শিশুরা জন্ডিজ, ক্রিমি, আমাশয়, ডায়রিয়াসহ নানারকম পেটের পীড়া ও নানাবিধ রোগব্যাধিতে অক্রান্ত হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা এসব খাবার খাচ্ছে। আর দরিদ্র পরিবারগুলো অর্থাভাবে এসব খাবার খাওয়ার ফলে সৃষ্ট রোগের সুচিকিৎসা করাতে পারছে না। ফলে এসব শিশুর বেশিরভাগই চিকিৎসাহীন থাকার ফলে ধীরে ধীরে কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাজারে দুধ, মাছ-মাংস, ফলমূলসহ বিভিন্ন সবজি দীর্ঘক্ষণ টাটকা রাখতে ফরমালিন ও ফলমূল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথোফেনসহ নানারকম বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। এছাড়া কৃষি ক্ষেত্রে শাকসবজি উৎপাদনে মাত্রারিক্ত নানা ধরনের রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও হরমোন ব্যহার হচ্ছে। যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একশ্রেণীর বিবেকহীন মুনাফালোভী মানুষ হরহামেশা এ ধরনের অমানবিক ঘটনা ঘটিয়ে চললেও অজ্ঞাত কারণেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী খাওয়ার ফলে মানব দেহের নার্ভগুলো ক্রমশ অকেজো হয়ে যায়। এতে স্থায়ীভাবে প্যারালাইসিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে শিশুদের হজমশক্তি কমে যায় এবং কেমিক্যালের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হাড় শক্ত হতে পারে না। বর্তমানে ভেজাল খাদ্যসামগ্রীর কারণে শিশুদের ফুসফুসের সংক্রমন, রক্ত সরবরাহ বিঘিœত হওয়া, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার ইত্যাদি নষ্টসহ মরণব্যাধি আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যের কারণে সৃষ্ট এসব রোগ প্রতিরোধে ওষুধের কার্যকারিতা থাকে না। ভেজাল খাদ্যে শিশুদের ক্যান্সারের ঝুঁকি সব চাইতে বেশি। তাই আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে খাদ্যে বিষ মেশানো ও ভেজাল রোধের কোন বিকল্প নেই।
ষ লেখক : দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) সংবাদদাতা, দৈনিক ইনকিলাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন