এম রফিকুল ইসলাম মিলন
ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় এনে সারা পৃথিবী এখন এ ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৫ সালের মে মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ৪৮তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে সারাবিশ্বে তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি আন্তজার্তিক স্বাস্থ্যচুক্তি প্রণয়নের প্রস্তাব (১১নং প্রস্তাব) গৃহীত হয়। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯২টি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সম্মতিতে ২০০৩ সালের মে মাসে ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে এই প্রথম আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য চুক্তি ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)’ অনুমোদন হয়। ১৬ জুন ২০০৩ সালে বাংলাদেশ এই চুক্তিতে প্রথম স্বাক্ষর করে। উল্লেখ্য, জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে এ চুক্তিতে বাংলাদেশ ১ম স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ২০০৪ সালের ১০ মে উক্ত চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করে। ফলে বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণে একধরনের দায়বদ্ধতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যদিও তামাক কোম্পানিগুলোর প্রবল প্রতিবন্ধকতা ও কুটকৌশল থাকা সত্ত্বেও সরকার জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় এনে ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করে এবং এ আইন ঐ বছরই ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়। ২০০৬ সালে একটি বিধিও প্রণয়ন করে। এ আইন ও বিধি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল গঠন করেছে যার মাধ্যমে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে এ কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স গঠন করেছে, যেখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, সিভিল সোসাইটি ও বেসরকারি সংগঠন সম্পৃক্ত রয়েছে। আইন প্রণয়নের প্রায় ৮ বছর পর বাস্তব ভিত্তিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে সকল প্রতিবন্ধকতা দেখা গিয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী করা হয়। ২০১৫ সালে সংশোধিত আইনের বিধিও প্রণয়ন করা হয়। এফসিটিসির ১১ ধারায় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও ২০০৫ সালের প্রণীত আইনে সচিত্র ছবি মুদ্রণের কোন বিধান রাখা হয়নি। শুধুমাত্র সিগারেটের প্যাকেটে ৩০% জায়গাজুড়ে ৬টি স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিধান উল্লেখ ছিল যা পর্যায়ক্রমে তামাক কোম্পানিগুলো ৬ মাস অন্তর অন্তর প্যাকেটে মুদ্রণ করে। কিন্তু যারা পড়তে জানেন না বা নিরক্ষর এ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী তাদের কোন কাজে আসেনি। এছাড়া এ সতর্কবাণী শিক্ষিত লোকের কাছেও খুব একটি আবেদন আনতে পারেনি। যে উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী প্রদান করা হয়েছিল যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়নে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি। ২০১৩ সালে সংশোধিত আইনে ৩০% এর স্থলে ৫০% জায়গাজুড়ে ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাকজাতদ্রব্যের প্যাকেটে মোট ৯টি সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর পর্যায়ক্রমে মুদ্রণের বিধান আরোপ করা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
প্রচলিত একটি কথা রয়েছে, একটি ছবি হাজার শব্দের চেয়েও শক্তিশালী। সিগারেটের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদানের ফলে হয়তো অনেক মানুষেরই জীবন রক্ষা পাবে। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যারা লিখতে পড়তে জানে না বা নিরক্ষর তাদের জন্য এ ছবি অধিক কার্যকর হবে। আবার লিখতে পড়তে জানে তাদের জন্যও এ ছবি ক্ষতিকর দ্রব্য হিসেবে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। আইনে বলা হয়েছে, তামাকজাতদ্রব্যের প্যাকেটে ৫০% জায়গাজুড়ে চার রঙের নির্দিষ্ট ফন্ট ও সাইজে যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিধান রয়েছে, এ বিধান সংশ্লিষ্ট তামাক কোম্পানিগুলো মুদ্রণ নিশ্চিত করবে। তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর গুরুত্ব সারাবিশ্বে স্বীকৃত। গবেষণায় দেখা গেছে দৈনিক এক প্যাকেট সিগারেট ব্যবহারকারী একজন ধূমপায়ী সিগারেট কেনা ও ব্যবহার করার সময় দিনে কমপক্ষে ২০ বার, বছরে ৭,০০০ বার সিগারেটের প্যাকেটে ছাপানো ছবি দেখে থাকে। অর্থাৎ এটি এমন একটি কার্যকর এবং সরকারের জন্য সাশ্রয়ী পন্থা যা তামাক ব্যবহারের সময় প্রতিবারই ব্যবহারকারীকে তামাকের ক্ষতি সম্পর্কিত বার্তা প্রদান করতে থাকে। একই সাথে এ সচিত্র প্যাকেটটি বহন করে তার বাসায় নিলে তার পরিবারের লোকজনও বিশেষ করে কিশোর, শিশু এবং যুবক বয়সের ছেলেমেয়েরাও জীবনের প্রথম ধাপেই এ বিষয়ে সতর্ক হবে। পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য অধূমপায়ী লোকজন পরিবারের মধ্যে ধূমপায়ী ব্যক্তিকে ধূমপান ত্যাগ করতে সহায়তা করবে।
২০০১ সালে কানাডা প্রথম সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রথা প্রবর্তন করে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৮০টিরও বেশি দেশে তামাকজাতদ্রব্যের প্যাকেটে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ প্রথা চালু আছে। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ (শতকরা ৯০%) জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী চালু রয়েছে। এছাড়াও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ৮৫%, থাইল্যান্ড ৮৫%, শ্রীলঙ্কা ৮০% ও ইন্দোনেশিয়ায় ৪০% সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বিদ্যমান। সারাবিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি রয়েছে (যেমন, বিজ্ঞাপন বন্ধ, সিগারেটের উপরে করবৃদ্ধি, ধূমপান ত্যাগে কাউন্সিলিং, আইনের প্রয়োগ ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ) তার মধ্যে সর্বাধিক কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে সিগারেটের প্যাকেটে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সিঙ্গাপুরে ২০০৪ সালে সচিত্র সতর্কবাণী প্রবর্তনের পর সেখানে ২৮% ধূমপায়ী ধূমপানের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। ১৪% ধূমপায়ী শিশুদের সামনে এবং ১২% ধূমপায়ী গর্ভবতী নারীদের সামনে ধূমপান করা থেকে বিরত থেকেছে। ব্রাজিল ২০০২ সালে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রচলন করার পর ৬৭% ধূমপায়ী ধূমপান ত্যাগের ইচ্ছা পোষণ করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ২০০৬ সালে কার্যকর হওয়ার পর সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ৩৬% ধূমপায়ীকে ধূমপানের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করেছে।
উন্নত বিশ্বে শুধুমাত্র ধোঁয়াযুক্ত তামাকের প্রচলন রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে ধোঁয়াযুক্ত তামাকের পাশাপাশি ধোঁয়াবিহীন সিগারেটের প্রচলনও ব্যাপক। উল্লেখযোগ্য যেমন, গুল, জর্দা, সাদাপাতা ইত্যাদি। এ সকল তামাকজাতদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে উঠেছে। যারা অনেকেই প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে উৎপাদন করে বাজারজাত করে থাকে। বর্তমানে গুলের ব্যবহার এখন নি¤œবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ বিত্তের ভিতরেও ব্যাপকভাবে ব্যবহারিত হচ্ছে। ঢাকা শহরের সকল বিড়ি সিগারেট বিক্রির দোকানে হাতের নাগালেই অতি সহজে স্বল্পমূল্যে এ দ্রব্যটি পাওয়া যায়। এছাড়া সাদাপাতা ও জর্দার ব্যবহার গ্রাম ও শহরের অধিকাংশ পরিবারের মধ্যেই পানের সাথে এটি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। রাস্তাঘাটেও সকল পান, বিড়ি, সিগারেটের দোকানেও এর প্রচলনও ব্যাপক। এক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশে ৩৮টি জেলায় ১২৩টি কারখানায় ২২৫টি ব্র্যান্ডের জর্দা উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে এবং ১১টি জেলার ২৩টি কারখানায় ১৮ ধরনের গুল উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এ উৎপাদিত ধোঁয়াবিহীন তামাকজাতদ্রব্য সিগারেট ব্যবহারের চেয়েও আরও অধিক ভয়াবহ। বিষয়টি বিবেচনায় এনে আইনে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রেও দুটি আলাদা সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নির্ধারণ করা হয়েছে। গুল বা জর্দা ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে হলে এসকল কোম্পানীকেও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও অত্যন্ত জরুরি। এ সকল কোম্পানী সরকারের সংশ্লিষ্ট তালিকাতেও হয়তো লিপিবদ্ধ নেই। তথাপিও সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে উৎপাদিত পণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ নিশ্চিত করা আবশ্যক।
বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী বাংলাদেশ নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এখন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের উচ্চাভিলাষী ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এমডিজি বাস্তবায়নের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং এমডিজির সাফল্যের উপর ভর করে এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ২০৩০ সালের এজেন্ডা হচ্ছে একটি সম্মিলিত পথ পরিক্রমা। এই পথ অতিক্রম করার ক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। তামাকজনিত রোগবালাই এবং অসংক্রামক রোগের অব্যাহত প্রকট হ্রাসে এসডিজি ৩ এ বর্র্ণিত সুস্থ্য জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে। সর্বোপরি, দেশের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এবং এসডিজি বাস্তবায়নে সহায়তায় আইন অনুযায়ী ১৯ মার্চ ২০১৬ থেকে সকল প্রকার তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান বর্তমান সরকারের একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
ষ লেখক : টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, মাদকদ্রব্য ও নেশাবিরোধী কাউন্সিল (মানবিক) ও বোর্ড অব ট্রাস্টি, বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন