জামালউদ্দিন বারী
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য ও সম্পদ। অজ¯্র প্রাকৃতিক-বনজ সম্পদ, অতুলনীয় জীববৈচিত্র্য, বিস্তৃতি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের দিক বিচার করলে সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট আমাজন জঙ্গলের পরই বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের স্থান। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, ইরাবতি ডলফিনসহ বিভিন্ন বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী, পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল বা অভয়ারণ্য হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের পরিবেশবাদী ও প্রকৃতি প্রেমিকদের অন্যতম আগ্রহের স্থান। দক্ষিণ আমেরিকার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্যের সাথে যেমন দক্ষিণ আমেরিকার ৯টি দেশের প্রায় ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা অঞ্চলে বিস্তৃত আমাজন জঙ্গলের ঐতিহ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, একইভাবে সুন্দরবনের বিস্তৃতি আমাজনের তুলনায় অনেক কম হলেও গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও বিবর্তনের অন্যতম প্রভাবশালী অনুঘটক হিসেবে সুন্দরবনের গুরুত্ব অনেক বেশি। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেট চেঞ্জ, জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এমনিতেই বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ভালনারেবল কান্ট্রি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মহান ¯্রষ্টা সুন্দরবনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একটি প্রতিরক্ষা দেয়াল ও ছাঁকনি হিসেবে। আমাদের নদ-নদী, পাহাড়, মাটি, জলাভূমি ও বনভূমির অস্তিত্ব সমহিমায় ঠিক থাকলে আগামী বহু বছর ধরে এই দেশ সভ্য মানুষের আবাদ ও বসবাসের উপযোগী থাকবে।
আমাদের কৃষিবিভাগ অপরিক্ষীত হাইব্রিড ও জিএমও বীজ উন্মুক্ত করে। বছরে কোটি কোটি ডলারের সার, কীটনাশক (পেস্টিসাইড), ছত্রাকনাশক (ফাঙ্গিসাইড), আগাছানাশক (হার্বিসাইড), মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পোল্ট্রিফিড এবং ব্যাপকহারে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল সেচ সুবিধার ওপর ভর করে যেনতেন প্রকারে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির যে তৎপরতা চালাচ্ছে, তা এক সময় আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দেশের পরিবেশবাদীরা বহু আগে থেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। গত কয়েক দশকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিতে আর্সেনিক বিষ সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর সেচ পাম্পের নাগালের নিচে নেমে গেছে। নদী ও জলাশয় শুকিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোথাও কোথাও মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যদিক এ সময়ে দেশের কোটি কোটি মানুষ কিডনি জটিলতা, ক্যান্সার, হৃদরোগসহ নানা ধরনের মরণব্যাধি ও স্বাস্থ্য জটিলতার শিকার হয়েছে। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবেশের বিরুপ প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারি-বেসরকারি ব্যয়ের বিষয়টি বাদ দিলেও শুধুমাত্র ক্যান্সার, কিডনি এবং হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ মানুষ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। গ্রামের সাধারণ কৃষক, ক্ষেতমজুর থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত এলাকার ধনাঢ্য পরিবারের সদস্য পর্যন্ত কেউই এখন দেশে বিদ্যমান এপিডেমিক স্বাস্থ্যঝুঁকির বাইরে নয়। যেনতেন প্রকারে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করার অপরিকল্পিত উদ্যোগের কারণে নাগরিক সমাজকে যে পরিমাণ স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা সম্ভবত খাদ্য ঘাটতি অথবা বাড়তি খাদ্য উৎপাদনের খরচের চেয়ে অনেক বেশি । যদিও শুধুমাত্র আর্থিক মূল্যে বা মানদ-ে সব ক্ষতির হিসাব করা সম্ভব নয়। সুস্বাস্থ্য ও নিরোগ দেহ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সাময়িক পদক্ষেপ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেমন অসুস্থ করে তুলছে, একইভাবে আমাদের মাটি, পানি, বায়ু এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করার মধ্য তা দিয়ে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তাকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মাটি, পানি, বাতাসের বিশুদ্ধতা ধ্বংসের সাথে সাথে হাজার বছরে গড়ে ওঠা দেশীয় কৃষিব্যবস্থা ও বীজ ব্যবস্থাপনাকেও বহুজাতিক এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানির কাছে বন্ধক রাখা হচ্ছে। একইভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চাহিদা পূরণের নামে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় বনভূমি থেকে শুরু করে সুন্দরবন পর্যন্ত বড় ধরনের হুমকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের পরিবেশ সচতেন নাগরিকবৃন্দ থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষও এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বোধ করছেন। সুন্দরবন নিয়ে আমাদের পরিবেশবাদীদের চেতনা জাগ্রত হওয়ার আগে থেকেই ইউনেস্কো, রামসারসহ আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের কাছে কিছু পরামর্শ ও সুপারিশ পেশ করে আসছিল। সুন্দরবনের ভেতরে শ্যালা নদীতে জ্বালানি বোঝাই জাহাজ ডুবে পানি দূষণ ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল অবারিত রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিশেষ সুপারিশমালা প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের ৭ তারিখে শ্যালা নদীতে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল বোঝাই ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-সেভেন’ নামের একটি অয়েল ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার সুন্দরবন যে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল তা সারা বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হিসেবে বিশ্ব গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছিল। এর আগেও বহুবার কয়লা, পাথর, চুনাপাথর, ও জ্বালানি তেল বোঝাই ছোটখাটো ট্রলার সুন্দরবনের নৌ-চ্যানেলে ডুবেছে। সুন্দরবনের ভেতর বাণিজ্যিক নৌ-চলাচলের ইমপ্যাক্ট বা এসব দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও কম হয়নি। তবে ২০১০ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাইট হিসেবে সুন্দরবনের স্পর্শকাতর ও পরিবেশগত বিপদসীমার মধ্যে অবস্থির রামপালকে বেছে নেয়ার পর সুন্দরবনের ভেতর বাণিজ্যিক কর্মকা- বৃদ্ধির সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে নতুন নতুন নানা রকম তথ্যের সমাহার বাড়তে থাকে। রামপালকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচিত করার পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ বিভাগ, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন অন্ধ ও বধিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে সুন্দরবনের ওপর তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না বলে যত্রতত্র সাফাই গাওয়া শুনতে শুনতে আমাদের পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজ বিরক্ত। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে সেখানে বছরে কোটি কোটি টন কয়লা পোড়ানো হবে, এসব কয়লা সমুদ্র ও নদীপথে ভারত থেকে রামপালে নেয়া হবে। গবেষকরা বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে ৭৯ লাখ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হবে, যা ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। লাখ লাখ টন পোড়া কয়লার ছাই-ভস্ম, বিষাক্ত রাসায়নিক, ধোঁয়া আশপাশের শত বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের বাতাস, গাছপালা, পাখি ও বন্যপ্রাণী মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশগত ক্ষতি কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। তবে ব্যাপক জনমত এবং পরিবেশগত হুমকি উপেক্ষা করে সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কত বছর পর সুন্দরবনের ওপর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব সৃষ্টি হবে সে বিতর্কে ধরি প্রবেশের প্রয়োজন নেই ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ডুবে যাওয়ার পর যে প্রকিয়া লক্ষ্য করা গেছে তাতেই বুঝা যায় সুন্দরবনে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বাড়লে ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন কি হবে বা হতে পারে। সুন্দরবনের শত শত বর্গমাইল এলাকায় সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার তিন দিনের মাথায় বিরল প্রজাতির ডলফিন, নানা জাতের মাছ, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন ধরনের জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠতে দেখা গেছে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জলাভূমিতে প্রজন্মান্তরে শাঁসমূলীয় বৃক্ষ থেকে নতুন বৃক্ষের অঙ্কুরোদগম। ফার্নেস অয়েলের ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার পর হাজার হাজার হেক্টর প্যারাবনের শাঁসমূল জ্বালানি তেলের প্রলেপে ঢাকা পড়ে গেছে। লাখ লাখ চারাগাছ অঙ্কুরেই ধ্বংসের মুখে পড়েছে। নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর মৎস্যজীবী ও গলদা চিংড়ির রেণু সংগ্রহকারী হাজার হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সাথে ইরাবতি ডলফিনের পুরো একটি প্রজন্মই সুন্দরবনের এ অংশ থেকে বিদায় নিয়ে সমুদ্রে অথবা ভারতীয় অংশে চলে গেছে বলে স্থানীয় জেলে ও পরিবেশবাদীরা জানিয়েছিল। বনদস্যু ও বনলুটেরাদের হাতে ইতোমধ্যেই সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। গত দুই দশকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়ে বিলুপ্তির আশঙ্কাকে ঘনীভূত করেছে।
সুন্দরবনের ধ্বংস নিশ্চিত করতে এখন আর নির্বিচার গাছ কাটা, হরিণ শিকার, বাঘ শিকার ও অপরিকল্পিত মৎস্য শিকারের প্রয়োজন হবে না। মাঝে মধ্যে দু-একটি কয়লাবাহী, তেলবাহী, চুনাপাথর ও শিল্প-কারখানার ভারী রাসায়নিকবাহী ট্যাঙ্কার ডুবিয়েই সেই কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব। শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনাকে অনেকেই সাধারণ দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। একটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত সুন্দরবন দূষিত করাকে ষড়যন্ত্রের অংশ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্যালা নদীর জয়মনি থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন খালে এই দূষণ তৎপরতা চলছে বলে একজন বন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যদি আর কোনো দুর্ঘটনা নাও ঘটে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরের জলাভূমিতে সাড়ে তিন লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সুদীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তবে দুঃসংবাদ হচ্ছে, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সুন্দরবনের নৌ-চ্যানেলগুলোতে মালবোঝাই নানা ধরনের নৌযান ডুবছে। গঙ্গা ও তিস্তার উজানে ভারতের বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলাদেশে হাজার হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ ইতিমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। এখনো সারা দেশে অবশিষ্ট কয়েক হাজার কিলোমিটার নৌপথে বাণিজ্যিক নৌ পরিবহন চলছে। তবে এসব নৌপথে কি সুন্দরবনের মতো যত্রতত্র জাহাজ ডুবি হচ্ছে? পার্থক্যটা আঁচ করতে পারলেই সুন্দরবন ধ্বংসের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। সুন্দরবনের নৌ-চ্যানেলগুলোতে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। এর সব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর শ্যালা নদীতে সাড়ে তিনশ টনের বেশি ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ ডুবির পর দেশি-বিদেশি প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে কিছু দিন বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের ওপর একটি কাগুজে নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল। তবে এর ৫ মাসের মাথায় ২০১৫ সালে মে মাসের প্রথম সপ্তায় শ্যালা নদীতে একটি রাসায়নিক সারবাহী জাহাজ ডুবির সংবাদ গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। এরপরে অক্টোবরে কয়লাভর্তি জাহাজডুবিসহ এমন আরো অনেক নৌ-দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেছে। চলতি সপ্তাহে গত ১৯ মার্চ (শনিবার) এক হাজার ২৩৫ টন কয়লাসহ এমভি সি হর্স-১ নামের একটি লাইটারেজ কার্গো জাহাজ ডুবে যাওয়ার সংবাদ পরের দিন ২০ মার্চ প্রকাশিত হয়। সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত হরিণটানা এলাকায় কার্গো জাহাজটি তলা ফেটে ডুবে যায়। এভাবেই অব্যাহতভাবে চলছে সুন্দরবনের ধ্বংসযজ্ঞ। এবারো জাহাজডুবির কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্তে যা-ই উঠে আসুক এসব তদন্ত রিপোর্ট থেকে অবস্থ্রা কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা দূরাশা মাত্র।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে আরো ৫ বছর আগেই। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটু পেছনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতের এনটিপিসি (ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি) ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভারতীয় উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব দিলে এর পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির তথ্যাবলী যাচাই করে বাতিল তা করে দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এরপর এই প্রকল্পটিকে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বা বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে গণ্য করে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বিপিডিবি এবং এনপিটিসির সমন্বয়ে একটি নতুন এন্টারপ্রাইজ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) নাম দিয়ে রামপালে সুন্দরবনের পরিবেশগত বিপদসীমার ভেতরে এ স্থাপনের উদ্যোগ এগিয়ে চলছে। শুরু থেকেই দেশি-বিদেশি প্রতিবাদ, আশঙ্কা এবং নানা ধরনের বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের জন্য এই প্রকল্পটিকে একটি অনিবার্য ধ্বংসের স্মারক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এসব অকাট্য যুক্তি খ-ন ছাড়াই কাজ চালিয়ে নেয়ার কথাই বার বার বলা হচ্ছে। মূলত বামপন্থি রাজনৈতিক মতাদশের্র নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ নামের একটি সংগঠন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বারের মতো লংমার্চ কর্মসূচি পালন করেছে গত সপ্তায়। লংমার্চে ব্যাপক জনসমর্থন ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। গত শুক্রবার ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, রামপালে সুন্দরবনের স্পর্শকাতর এলাকায় কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে এবার ভারতীয় পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিক সমাজও প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ভারতের এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ (সিইপিআর), ভারত বিজ্ঞানযাত্রা, দিল্লি সলিডারিটি গ্রুপ, মাচ্ছিমার অধিকার সংঘর্ষ সংগঠন এবং জাতীয় মৎস্যজীবী ফোরামের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও উপকূলীয় প্রতিবেশ’। এই সেমিনারে বক্তারা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ভারতীয় অংশেও এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা করেছেন। ভারতীয় পরিবেশবাদীরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ভারতে কিছু কিছু এলাকার জনসাধারণের প্রতিবেশ ও জীবন-জীবিকা হারানোর তথ্যও তুলে ধরেন। পরিবেশগত ভারসাম্য এবং সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের চিরায়ত পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ায় ভারতে অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ আদালতের নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে বলে স্বীকার করেছেন। তবে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা সত্ত্বেও সুন্দরবন এলাকা থেকে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প চিন্তাও সরকারের নেই বলে জানা গেছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে অন্তত ১০ লাখ মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে প্রত্যক্ষ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা দাবি করেছেন। মূলত সুন্দরবন ধ্বংসে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এদেশের ১৬ কোটি মানুষ, পুরো বাংলাদেশ, এমনকি গঙ্গা-যমুনা অববাহিকার ভারত ও বাংলাদেশের বিশাল অংশের প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত ভারসাম্য।
বিশ্বে উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণা দ্রুত পাল্টাচ্ছে। এমনকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতানুগতিক মানদ-ও এখন আর আগের মতো গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। এখন গতানুগতিক জিডিপির পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন ও জিএনএইচ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) একটি নতুন সূচক হিসেবে আত্মপ্রকাশিত হচ্ছে যেখানে অনাগত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পরিবেশ-প্রতিবেশ নিশ্চিত করার ঐকান্তিক প্রতিশ্রুতি আছে। এখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য উৎসের প্রতি জোর দিচ্ছে সারা বিশ্ব। মাত্র পাঁচ দশকেই আমরা আমাদের রাজধানীসহ শহরগুলোকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলেছি। বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য ও অনিরাপদ শহরগুলোর তালিকার প্রথম ও দ্বিতীয় নম্বরে স্থান পাচ্ছে আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরী। আমাদের নদীগুলোও দূষণে, দখলে এবং উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। নদীবাহিত পলিমাটিতে গড়া এক সময়ের উর্বর জনপদে এখন সুপেয় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। আমাদের যৎসামান্য পাহাড় নিয়েও চলছে নানাবিধ ষড়যন্ত্র। এখন বিপুল সম্ভাবনাময় উপকূলীয় অঞ্চল এবং সুন্দরবনকে দূষণে-দখলে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারলেই বাংলাদেশের সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হয়। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের মতো বিকল্পহীন প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যকে ধ্বংসের মুখোমুখি নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের হাজারটা বিকল্প আছে। কোনো অর্থেই সুন্দরবনের বিকল্প নেই। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের নামে সুন্দরবনের ওপর নিকট ও দূরবর্তী ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের ভয়াবহ একটি প্রকল্প বন্ধুপ্রতিম দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। বাংলাদেশ এবং ভারতের পরিবেশ সচেতন ও সহমর্মী নাগরিক সমাজ এই জয়েন্টভেঞ্চারকে ফ্রেন্ডশিপ ভেঞ্চার হিসেবে মেনে নিতে পারছে না।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন