শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

উর্বরা শক্তি হারিয়ে বিপুল পরিমাণ জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা

দামুড়হুদায় ২শ’ হেক্টর জমিতে তামাক আবাদ

প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় ব্যাপকভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফসল তামাকের আবাদ হচ্ছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এলাকার কৃষি ও জনস্বাস্থ্য। বিপুল পরিমাণ জমিতে তামাক আবাদের কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে এলাকায় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। একই জমিতে বারবার তামাক চাষের ফলে উর্বরা শক্তি হারিয়ে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি অনাবাদি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উৎপাদিত এসব তামাক পাতা শুকাতে পোড়ানো হচ্ছে নানা প্রজাতির হাজার হাজার মন কাঠ। ফলে বনভূমি উজাড় হয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় ৩টি কোম্পানীর আওতায় বিপুল পরিমাণ জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে। বৃটিশ আমেরিকা টোবাকো কোম্পানী, আবুল খায়ের কোম্পানী ও ঢাকা টোবাকো কোম্পানীর আওতায় তামাকের আবাদ করেছে এলাকার কৃষকরা। তামাক আবাদের ফলে হাতে গোনা কিছুসংখ্যক মানুষ লাভবান হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর। বেশ ক’বছর ধরে উপজেলার গোপালপুর, দলিয়ারপুর, বিষ্ণুপুর, ছুটিপুর, পোতারপাড়া, ভগিরতপুর, হোগলডাঙ্গা, কালিয়াবকরি, মজলিশপুর, রামনগর, কলাবাড়ী, নাপিতখালি, বদনপুর ইত্যাদি গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে তামাকের আবাদ হচ্ছে। সূত্র জানায়, অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও তামাক কোম্পানীগুলো মৌসুমের শুরুতেই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদেরকে বিনামূল্যে বীজ এবং ঋণ হিসাবে সার, কীটনাশক এবং নগদ টাকা দেয়। ইতোমধ্যে চাষীরা তামাক ক্ষেতের পরিচর্যার সাথে সাথে তামাক পাতা শুকানোর প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। প্রত্যেকটি কোম্পানী তাদের আওতাধীন তামাকচাষীদের মাঝে  উৎপাদিত তামাক কেনার জন্য কার্ডও সরবরাহ করেছে। আর ক’দিন পর ওই কার্ড দেখিয়েই কৃষকরা স্ব-স্ব কোম্পানীর কাছে তাদের উৎপাদিত তামাক বিক্রি করবেন। তারা আরও জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোতে তামাকের আবাদ করে অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভবান হওয়ায় গতবারের তুলনায় এবারও অনেক বেশি জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে। তামাকচাষী গোপালপুর গ্রামের কালাম মেম্বর, ওমর আলি, আজিজ, রাজ্জাক, কোরবান, খোকন, নিজাম, আশরাফুল, জিনারুল, হোগলডাঙ্গার শফিউদ্দীন, বদনপুর গ্রামের হাসেম, নুর ইসলাম, মজলিশপুর গ্রামের রুহুল আমিন, লাড্ডু, আজিবুল, গোলাম রসুল, শান্তি, দলিয়ারপুর গ্রামের তৌহিদুর, আশিক বলেন, আমরা জানি তামাক স্বস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তার পরও গত কয়েক বছর ধরে ধান, পাট, সবজিসহ নানা প্রকার ফসলের আবাদ করে লোকসান হওয়ায় বাধ্য হয়েই লোকসান বাঁচাতে তামাক চাষ করি। তামাকের আবাদ করলে শুরু থেকেই কোম্পানীর লোকেরা তামাক চাষের ব্যাপারে নানারকম পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ফলে তামাক চাষ করে কখনও লোকসান হয় না। কিন্তু অন্যান্য ফসলের আবাদ করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকসান গুনতে হয়। আর কৃষি বিভাগ থেকেও তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা বা পরামর্শ পাওয়া যায় না। ফলে এলাকার অনেক মানুষ আমাদের মতই অন্যান্য ফসলের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাকের কারনে মুখ, গলা ও ফুসফুসের ক্যান্সার, হাপানি, আলসার, হৃদরোগ, যৌনক্ষমতা হ্রাস, প্যারালাইসিস, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, যক্ষা, দাঁত ও মাড়ি বিবর্ণ, ক্ষয়প্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মৃত ভ্রƒণ ও অপরিনত শিশুর জন্ম নেয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তামাকজাত দ্রব্য বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, সাদাপাতা, জর্দা, গুল ও খৈনি সেবনের কারনে প্রতিদিন ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, হাপানি, হার্ট এ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তামাক সেবনের ফলে প্রতি বছর দেশে ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায়। সেইসাথে পঙ্গুত্ববরণ করছে ৩ লক্ষ ৮২ হাজার মানুষ। তামাকের কারণে অসুস্থ্য রোগীদের  চিকিৎসার পিছনে শুধু সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। অথচ সেক্ষেত্রে এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪০ হাজার লোক ফুসফুস ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ৯০ শতাংশই তামাক ব্যবহারের কারণে হয়ে থাকে। ফুসফুসের ক্যান্সার খুব দ্রুত ছড়ায় বলে এর চিকিৎসাও বেশ কঠিন। সে কারনে এর মধ্যে ৭০ শতাংশ রোগিই বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে ২২% রোগী ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত যা এককভাবে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লক্ষাধিক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ২২% মানুষই ফুসফুস ও স্বরতন্ত্রের ক্যান্সারে অক্রান্ত হচ্ছে। এলাকায় তামাকের আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় দিন দিন অন্যান্য ফসলের আবাদ কমে যাচ্ছে। তামাক চাষের ফলে এলাকার কৃষিজমির উর্বরতা, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়ছে। এছাড়াও তামাক চাষের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চরম রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। সম্প্রতি সরকার তামাক ব্যাবহারে প্রতি মানুষকে অনুৎসাহিত করতে নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নিলেও তামাক উৎপাদন বন্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে দিন দিন তামাকের আবাদ বেড়েই চলেছে। বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মেজাবউল হক জানান, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে  তামাক ব্যবহারের ফলে ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের জটিল রোগ হয়। ধূমপান ও বিভিন্নভাবে তামাক ব্যবহারে স্বাস্থের ক্ষতি সম্পর্কে অনেকে সচেতন থাকলেও তামাক চাষের ফলে কৃষক ও তার পরিবারের সদস্যদের কি পরিমাণ ক্ষতি হয় সে বিষয়ে অনেকেরই ধারণা নেই। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন কাঁচা তামাক নাড়াচাড়া করলেও গ্রিন টোবাকো সিক্নেসি নামক এক ধরনের রোগ হয়। এ রোগের ফলে মাথাঘোরা, বমি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ও শ্বাসকষ্ট হয়।   উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুফি মোঃ রফিকুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২শ’ হেক্টর জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে। তামাক চাষের ব্যাপারে সরকারি কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে একই জমিতে বার বার তামাক চাষ করলে জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমরা চাষীদেরকে তামাকের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষের পরামর্শ দেই। তামাক চাষের ব্যাপারে আমরা চাষীদেরকে নিরুৎসাহিত করে থাকি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন