আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্যর মধ্যে অপরাধ প্রবণতা এবং মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়া নতুন কিছু নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সৃষ্টির পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ চলে আসছে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে একশ্রেণীর পুলিশ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। এমন কোনো অপরাধ নেই, যাতে তারা জড়াচ্ছে না। ঘুষ-দুর্নীতিতো আছেই, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, মাদক ব্যবসার মতো ভয়াবহ অপরাধে পর্যন্ত তারা জড়িয়ে পড়েছে। খোদ পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানেই পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। এ নিয়ে বিগত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদেনে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলা হয়েছে, গত প্রায় ৬ বছরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার পুলিশ সদস্য শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। মাসে গড়ে সাড়ে ১১০০ সদস্যকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। দৈনিক অন্তত ৩৮ জন সদস্য আইন অমান্য করা থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে শাস্তি পাচ্ছে। এ চিত্র থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা কীভাবে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধী সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি প্রদান করার পরও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সচেতন হওয়ার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।
পুলিশ জনগণের বন্ধুÑএ কথাটি বাহিনীটির পক্ষ থেকে সবসময়ই বলা হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বারবার জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান ও তাদের সাথে ভাল আচরণ করার তাকিদ দেয়া হচ্ছে। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে বিরূপ ধারণা ও ভীতি দূর করার পরামর্শ এবং নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে। জনসাধারণকে পুলিশের সহায়তা নেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে আহŸান জানানে হচ্ছে। ৯৯৯ ফোন চালু করে পুলিশের সহায়তা নেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে একশ্রেণীর পুলিশ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ-নির্দেশের তোয়াক্কা না করে একের পর এক অপরাধ করেই যাচ্ছে। অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, বিচার বর্হিভূত হত্যাকাÐের মতো প্রায় নিয়মিত হয়ে পড়া অপরাধের পাশাপাশি এখন মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েছে। অনেককে মাদক হাতে ধরিয়ে বø্যাকমেইলও করা হচ্ছে। অনেক পুলিশ সদস্য হাতেনাতে ধরাও পড়েছে। বিষয়টি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অপরাধ দমনের পরিবর্তে একশ্রেণীর পুলিশ নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। অপরাধীদের সমান্তরাল হয়ে অপরাধ করে চলেছে। সম্প্রতি রাজধানীতে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার ঘটনা পুলিশ প্রশাসন থেকেই স্বীকার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, ছিনতাই বা অন্যান্য অপরাধ দমনে পুলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। পুলিশ সদস্যরাই যদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তবে অপরাধ দমন হবে কিভাবে? আইনের রক্ষক এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রক নিজেরাই আইনভঙ্গ করলে অপরাধীদের পোয়াবারো হয়ে দাঁড়ানোই স্বাভাবিক। এ থেকে তখন পরিত্রাণের আর কোনো উপায় থাকে না। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ কি? এর জবাবে, কমন একটি উত্তর পাওয়া যায়। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার সময়ই অনেককে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। সাধারণ মানুষও এটা জানে, পুলিশের চাকরি পেতে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপুল অর্থ দিতে হয়। অর্থ ছাড়া চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন। ফলে যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে পুলিশের চাকরি পায়, তার মোটিভই থাকে চাকরি পেতে যে ঘুষ দেয়া হয়েছে তা উঠানোর পাশাপাশি লাখপতি হতে হবে। বড়লোক হওয়ার অন্যতম সহজ পথ পুলিশের চাকরি পাওয়া। এমন একটি মানসিকতা পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যর মধ্যে রয়েছে। এছাড়া সরকারের প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নে রাজনৈতিক ব্যবহার তাদের মধ্যে আত্মঅহং সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে এ মনোভাব কাজ করে, আমাদের কারণে সরকার টিকে আছে। এতে চেইন অফ কমান্ড যেমন ভেঙ্গে পড়ে, তেমনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভয়ংকর অপরাধ করতেও তারা দ্বিধা করে না। অথচ পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বই হচ্ছে, অপরাধ ও অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের মধ্যে ভরসা, শান্তি ও স্বস্তি প্রতিষ্ঠা করা। পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর মারাত্মক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়া থেকে বোঝা যায়, তারা পুলিশ বাহিনীর এ নীতি ও আদর্শের ধার ধারে না।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অপরাধের বিষয়টি অনেকটা লঘু ভাবে দেখা হয়। যারা অপরাধ করে তাদের হয় ক্লোজড, না হয় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ধরনের শাস্তি পরবর্তীতে প্রত্যাহার হওয়ার পর, দেখা যায় তারা পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং এতে অন্য সদস্যরা অপরাধপ্রবণ হতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। গুরু পাপে লঘুদÐ দেয়ার এই অপসংস্কৃতি থাকায় পুলিশ বাহিনী থেকে অপরাধ কমানো যাচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী পুলিশ সদস্য তার খুঁটির জোরের কারণে রেহাই পেয়ে যায়। ফলে পুনরায় সে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং পড়ছে। পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি, এ বিষয়টি সবসময় জাগিয়ে রাখার জন্য পুলিশ বাহিনীতে নিয়মিত মোটিভেশন এবং কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। কিছু অপরাধী পুলিশ সদস্যর জন্য পুলিশের ভাবমর্যাদা বরাবরই নি¤œগামী। সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারে না। পুলিশ মানেই তারা ঝামেলা মনে করে। এ মনোভাব দূর করতে পুলিশকে অপরাধীর প্রতি কঠোর এবং সাধারণ মানুষের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন করে তোলার বিকল্প নেই। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার সময় নিয়োগ বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশকে অপরাধের ধরণ অনুযায়ী সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যে ধরনের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, সে ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। নামকাওয়াস্তে শাস্তি বা পুলিশ সদস্য বলে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ রাখা যাবে না। এ কথা মনে রাখতে হবে, পুলিশ সরকারের সেবার জন্য নয়, বরং সরকারের হয়ে চেইন অব কমান্ড মেনে সাধারণ মানুষের সেবা এবং জানমালের নিরাপত্তা বিধান করাই তাদের পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন