জাহেদ খোকন : রাত পোহালেই কালের গহŸরে হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি বছর। শুরু হবে নতুন বছর। কালের পরিক্রমায় এভাবেই দিন যায়, আসে নতুন প্রভাত। মাস ঘুরে আসে বছর। শেষ হচ্ছে ২০১৭, দোরগোড়ায় ২০১৮ সাল। বিশ্বের সব দেশের মত বাংলাদেশের জাতীয় ক্ষেত্রেও ২০১৭ সালটি ছিলো সাফল্য-ব্যর্থতার মিশ্রনে একটি বছর। এ বছর দেশে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যা জাতীয় ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। দেশের অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের মধ্যে ক্রীড়া অন্যতম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের খেলাধুলায় যতসামান্য সাফল্য এসেছে তা মেয়েদের হাত ধরেই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফুটবল। দেশের জনপ্রিয় এ খেলায় এই বছর যেখানে পুরুষ জাতীয় দলের কোনই ভুমিকা ছিলো না, সেখানে নারীরা উল্লেখ করার মত সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবলে ২০১৭ সালটি মেয়েদের সাফল্য দিয়ে শুরু হয়ে শেষও হয়েছে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে।
২০১৬ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে ভারতের শিলিগুড়িতে বসে সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের চতুর্থ আসর। টুর্নামেন্টের ফাইনালটি মাঠে গড়ায় চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি। নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, আফগানিস্তানকে পেছনে ফেলে ফাইনালে জায়গা করে নিলেও শিরোপা জিততে পারেনি লাল-সবুজের মেয়েরা। ফাইনালে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েই দেশে ফিরে সাবিনার দল।
এ বছরের শুরুতে রানার্সআপ হলেও শেষ দিকে কিন্তু ঠিকই চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ঘরে তুলতে সক্ষম হয় লাল-সবুজের মেয়েরা। ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’ এই প্রবাদকে সত্য প্রমাণীত করে বাংলাদেশ কিশোরী দল। চলতি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম সাফ অনুর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরার খেতাব জিতে নেয় তারা। ফাইনালে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ট্রফি ঘরে তোলে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৫ নারী দল। মাঝে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের চ‚ড়ান্তপর্বে অংশ নেয় বাংলাদেশের মেয়েরা। গত বছর ঘরের মাঠে এই টুর্নামেন্টেরই বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো লাল-সবুজের দল। কিন্তু চুড়ান্ত পর্বে এশিয়ার সেরা আট দলের অংশগ্রহণে তেমন সফলতা পায়নি কৃষ্ণা রানীরা। উত্তর কোরিয়ার, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে খালি হাতেই দেশে ফিরতে হয় তাদের। তবে শেষ ম্যাচে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়াকু ফুটবল খেলেন কৃষ্ণা, সাবিনা, সানজিদারা। ম্যাচে ৩-২ গোলে হারলেও সবার নজর কাড়ে বাংলাদেশের মেয়েরা। এই টুর্নামেন্টকে সামনে রেখে নিজেদের পারফরম্যান্স আরো শাণিত করতে চীন, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশ ভ্রমণ করে মনিকা, মারিয়া, শামসুন্নাহারা, আঁখিরা।
মেয়েদের পাশাপাশি বাংলাদেশের বয়শভিত্তিক পুরুষ দলও কিছুটা উজ্জ্বল ছিলো এ বছর। যার প্রমাণ বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৮ দল। গেল সেপ্টেম্বরে যেখানে থাইল্যান্ডে মেয়েরা অংশ নেয় এএফসি’র চুড়ান্ত পর্বে, সেখানে একই মাসে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৮ দলের ছেলেরা ভুটানে খেলে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপ। তাতে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে লাল-সবুজের তরুণ ফুটবলাররা। অল্পের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি তারা। গোল ব্যবধান ও পয়েন্ট সমান হলেও শুধুমাত্র হেড টু হেডের হিসাবে নেপাল চ্যাম্পিয়ন ও বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়। ভুটান থেকে ফিরেই অনুর্ধ্ব-১৮ দল তাজিকিস্তান যায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব খেলতে। এই টুর্নামেন্টের ‘বি’ গ্রæপে অংশ নিয়ে ছয় দলের মধ্যে তৃতীয়স্থান পায় বাংলাদেশ।
এ বছর সাফে ব্যর্থ হলেও এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে কিছুটা সফলতার মুখ দেখে বাংলাদেশ কিশোর দল। ২০১৫ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৬ দল। দুই বছর পর সেই আসরটি এবার গেল আগষ্টে নেপালে অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় পারেনি। সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নেয় লাল-সবুজরা। ভারত চ্যাম্পিয়ন, নেপাল রানার্স আপ, তৃতীয়স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় বাংলাদেশকে। সাফে ব্যর্থ হলেও এ দলটিই এক মাস পর সেপ্টেম্বরে কাতারে যায় এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব খেলতে। ইয়ামেনের সঙ্গে লড়াই করে ২-০ গোলে হারলেও স্বাগতিক কাতারকে তাদের মাটিতেই ২-০ গোলে হারিয়ে ‘ই’ গ্রæপে রানার্স আপ হয়। কিন্তু ১০ গ্রæপের বাছাইপর্বে সেরা পাঁচ রানার্স আপ হতে না পারায় চ‚ড়ান্তপর্বে ওঠা হয়নি বাংলাদেশের।
সবকিছু ছাপিয়ে চলতি বছর আলোচনায় ছিলেন জাতীয় ফুটবল দলের অস্ট্রেলিয়ান প্রধান কোচ অ্যান্ড্রু অর্ড। গত মে মাসে তাকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। কিন্তু নিয়োগ পাওয়ার সাত মাস পার হলেও এখনো জাতীয় দলের দায়িত্ব বুঝে পাননি অর্ড। পাবেন কিভাবে ২০১৬ সালের অক্টোবরে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে দূর্বল ভুটানের কাছে হারের পর যে জাতীয় দল আন্তর্জাতিক ফুটবলে বোতলবন্দি হয়ে আছে? ফলে ১৪ মাস আন্তর্জাতিক ম্যাচবিহীন জাতীয় দল ফিফা র্যাংকিংয়ের তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৯৭। এদেশের ৪৬ বছরের ফুটবল ইতিহাসে যা সর্বনি¤œ! আন্তর্জাতিক ফুটবলে শ্রীহীন বাংলাদেশ কিন্তু ঘরোয়া আসরেও ঢিমেতালে চলেছে। দেশের ফুটবলে পেশাদারিত্ব এসেছে প্রায় একযুগ আগে। কিন্তু এতোদিনেও শক্তিশালী হয়নি ঘরোয়া ফুটবল কাঠামো। বাফুফে আর ক্লাবগুলোর উদাসীনতাই মূলত এর জন্য দায়ী। ঘরোয়া ফুটবলের অনগ্রসরতার জন্য বাফুফে ও ক্লাবগুলোর কোনোভাবেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তাদের অনৈতিক চাওয়া-পাওয়া, দাবি-দাওয়ার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল)। এই হচ্ছি, হবে করে গত জুলাইয়ে বিপিএল শুরু করলেও ছয় মাস হতে চলল এখনো লিগ শেষ করতে পারেনি বাফুফে। লিগ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ আগামী বছরের ১৩-১৪ জানুয়ারি। জুলাইয়ে শুরু হলে লিগে এবার বেশ কয়েকবার ছেদ পড়েছে। কখনো যৌক্তিক কারণে, কখনো ঢুনকো অজুহাতে। এক মৌসুমে লিগ, ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপ, সুপার কাপ (এখন আর হয় না) আয়োজনের কথা থাকলেও এবার শুধু ফেডারেশন কাপই শেষ করতে পেরেছে বাফুফে। লিগ চলছে কচ্ছপ গতিতে, স্বাধীনতা কাপ মাঠে গড়ায়নি। এই টুর্নামেন্ট আগামী জানুয়ারিতে হবে এমনটাই জানিয়েছে বাফুফে সূত্র।
এতো কিছুর পরও কথা রাখতে পারেননি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। এ বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় জেলা চ্যাম্পিয়নশিপ (শেরে বাংলা কাপ) হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ এ বছর আয়োজন করতে পারেননি তিনি। যদিও তা চলতি বছরেই করার কথা ছিল। বছরের শেষ ভাগে ক্লাবগুলোর যুব দল নিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজনের কথাও বলেছিলেন সালাউদ্দিন। কিন্তু তা হয়নি। বাৎসরিক যে ক্যালেন্ডারসূচি দিয়েছিল বাফুফে তা মানা হয়নি, প্রতি মাসে একবার করে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হবেন বাফুফে সভাপতি এমন কথা থাকলে দু’মাস পরই এই আয়োজন বন্ধ করে দেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন