বহু পুরনো একটা প্রবাদ আছে, “যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি।” বিনোদনের এক অনুপম ও জনপ্রিয় বহু পুরনো মাধ্যম হলো সার্কাস। আজ বাংলার সেই সার্কাস যেন চিৎকার করে এই প্রবাদের কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে। এক সময়ের বাংলার জনপ্রিয় স¤্রাট সার্কাস, পানামা সার্কাস, ওয়েস্টার্ন সার্কাস, প্রভাত সার্কাস, কোহিনূর সার্কাস, মুন লাইট সার্কাস আজ শুধুই স্মৃতি। বাঙালি মাালিকের হাতে গড়া এই সব সার্কাস বাংলার প্রবীণদের কাছে এখন শুধুই গল্প কথা। কেন একে একে এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল সার্কাসগুলো ? অথচ এই শিল্পের সঙ্গে বিনোদনের ব্যাপার যেমন ছিল তেমনি ছিল কর্মসংস্থানের বিশাল সুযোগ। এক একটি সার্কাস ১৫০-২০০ পরিবারের মুখের আহার যোগাবার ব্যবস্থা করত। বাংলার সেই সার্কাস আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। সম্প্রতি নটরাজ সার্কাসেও দেকা গেল সেই একই চিত্র। সার্কাসের আনাচে-কানাচে দৈনতার চিহ্ন। বহু বছর আগে লেখা সাকাসের নামটাও আজ কালের ঝাপটায় বিবর্ণ হয়ে গেছে। মসলিনের মুখ্য পর্দাও আজ সময়ের শাসনে মলিন। আার্টিস্টদের ষোক হায়ক সরঞ্জামগুলোও বহ ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে পড়েছে। মাথার তাঁবুর টুকরো টুকরো ছেঁড়া দিয়ে দেখা যায় আকাশ। বৃষ্টি হলে তাকে ঠেকাবার কোনও বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। তবু বাংলার হাতে গোণা কয়েকটি সার্কাসের একটি নটরাজ সার্কাস টিকে থাকার জন্য সমানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু খেলা তারা সংযোজিত করেছে।
প্রায় ২৪ বছর সার্কস লাইনে আছেন মধাব চ্যাটার্জি। বর্তমানে তিনি বিখ্যাত এই নটরাজ সার্কাসের ম্যানেজার। সার্কাস নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ঈর্ষণীয়। নটরাজের আগে তিনি স¤্রাট সার্কাস, অজন্তা সার্কাস, ফেমাস সার্কাস, কোহিনূর সার্কাস, আসামের মুনলাইট সার্কাস ইত্যাদি সার্কাসের দায়িত্বেও ছিলেন। নটরাজে আছেন প্রায় বছর পাঁচেক। সার্কাসের দুর্দিনের কথা বলতে গিয়ে বলরেন, “বাংলায় সার্কসে চলছে এখন ভাটার টান। জোয়ারের দিন শেষ। সার্কাস চালানো চালানোই এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যেমন আমাদের এই নটরাজ সার্কাস, ৫০ বছরের এই সার্কাসের এমন দুর্দিন আগে কখনও আসেনি। বহু কষ্টে, টেনে-টুনে কখনও লাভ, তো কখনও লোকসান সয়ে এখনও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। শুধু নটরাজই নয় এখনও পর্যন্ত হোতে গোনা যে কয়েকটা সার্কাস কোনও মতে টিকে আছে তাদের সবারই অবস্থা একই।
বাংলার জনপ্রিয় সার্কাসের কেন এই বিপন্ন অবস্থা ? প্রশ্ন করাতে মাধববাবু বললেন, “সবচেয়ে বড় সমস্যা, সার্কাস এখন আর আগের মতো দর্শক টানতে পারে না। একটা সময় ছিল যখন সিনেমা বাদ দিলে মানুষের, বিশেষ করে কম বয়সের ছেলেমেয়েদের পাড়ার ছোটখাটো যাত্রা-থিয়েটার ছাড়া অন্য কোনও বিনোদনের ব্যবস্থাই ছিল না। সার্কাস এলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ত। এক এক জায়গায় সার্কাস এক মাস, দু-মাস ধরে চলত। যেখানে সার্কাসের তাঁবু পড়ত সেখানেই তা রমরমিয়ে চলত। আবার সেই সার্কাসকে ঘিরে বসত মেলাও। এখন আর সেসবের বালাই নেই। হাল আমলের সিনেমা, ঘরের টিভি এবং আধুনিক মোবাইল বিনোদনের সবটাই শুষে নিয়েছে। সার্কাস দেখে সময় নষ্ট করতে বেশির ভাগ মানুষই আর চায় না। বিশেষ করে টিভি বিশুদ্ধ বিনোদনের সবটাই কেড়ে নিয়েছে। এছাড়া জন্তু-জানোয়ারের খেলা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিষেধাজ্ঞাও সার্কাসের সর্বনাশের বাকিটা সম্পন্ন করেছে। সার্কাসের জীব-জন্তু, দেশি-বিদেশি পাখি, জলহস্তী, বাঘ-সিংহ শুধু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরই নয় বড়দের মনোরঞ্জনেরও একটা বড় সহায়ক ছিল। সার্কাসে জীব-জন্তুর খেলা দেখানো এখন প্রায় সবই নিষিদ্ধ। বাদ দিতে দিতে নটরাজ সার্কাসেও জন্তু-জানোয়ার এখন হাতে গোনা, গোটা তিনটে হাতি, একটা শীর্ণ উট, ছোট-বড় ১০-১২টা কুকুর আর একটা পাখি ।
আগে সার্কাস ভালো চলত তাই আর্টিস্টদের ভালো পারিশ্রমিকও দেওয়া যেত। এখন সেটাও সম্ভব হয় না। ফলে বিদেশি আর্টিস্ট তো দূরের কথা, মিজোরাম, কেরলা, তমিলনাড়–, অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম ইত্যাদি ভিন রাজ্যের আর্টিষ্ট আনাও দুষ্কর হয়ে গেছে। তবু আমরা আর্টিস্টদের যতটা সম্ভব পারিশ্রমিক দেওয়ার চেষ্টা করি। নটরাজের আর্টিস্টরা থাকা-খাওয়া ছাড়া গড়ে ১৫ থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত পারিশ্রমিক পান। প্রশিক্ষক (ট্রেনার), আর্টিস্ট ও নন-আর্টিস্ট মিলিয়ে নটরাজে আছেন প্রায় এক ’শো জন।
সার্কাস সঙ্কটে সম্প্রতি কালে সার্কাসে রাজনৈতিক দলের চাপ, স্থানীয় তোলাবাজদের চাপ, ক্লাবের চাপ, ইত্যাদিও অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে বাংলার সার্কাসে এখন সঙ্কটের ঘনঘটা।” ফলে আগামী কিছু দিনে বাংলার জনপ্রিয় এই বিনোদন মাধ্যম যদি ইতিহাসের কোলে গিয়ে ঠাঁই নেয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশেও আজ সার্কাসের একই অবস্থা। অথচ একদিন বাংলাদেশের মানুষ সার্কাসের অন্ধভক্ত ছিল। সার্কাসের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে সে আত্মহত্যা করেছে। এসবের মুলে দায়ি রয়েছে বর্তমান প্রযুক্তি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন