মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে

প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
বিনা স্বাধীনতায় মানুষ বাঁচতে পারে না। এখানে বাঁচা অর্থ, আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঁচা, আত্মবিকাশের মধ্য দিয়ে বাঁচা, সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে বাঁচা, অভিমত প্রকাশ ও অবাধ বিচরণের মধ্য দিয়ে বাঁচা। এই যে এভাবে বাঁচা, তার অনুকূল পরিবেশ যদি দেশে-সমাজে বিরাজমান থাকে তাহলে বলা যায়, ব্যক্তি বা সমাজের সদস্যরা স্বাধীনতা উপভোগের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে। মানুষ স্বভাবতই স্বাধীনতা অন্বেষী, স্বাধীনতাপ্রিয়। অনেকে বলে থাকেন, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। যারা এটা বলেন, তারা বুঝাতে চান, মানুষের স্বাধীনতাপ্রিয়তা জন্মগত। স্বাধীনতা উপভোগের আকাক্সক্ষা নিয়েই সে জন্মগ্রহণ করে। অনেকে আবার বলেন, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন হলেও জন্মের পর পরাধীনতার নানা শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সেই হিসেবে মানুষ কখনই স্বাধীন নয়। তারা আরও বলতে চান, মানুষ স্বাধীনভাবে বা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বুকে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মের পর পরাধীনতার শৃঙ্খলগুলো যখন তার চার পাশে দেখতে পায়, তখন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নিজেকে মুক্ত করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়। শুরু হয় শৃঙ্খল ভাঙার সংগ্রাম। পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের সংগ্রাম মানব জীবনের একটি অবিরাম সংগ্রাম।
ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন তেমনি জাতি বা জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। ব্যক্তির সম্মেলন বা সমাবেশের মধ্য দিয়ে কোনো জনগোষ্ঠী, সমাজ বা জাতি গড়ে ওঠে। অনিবার্য কিছু বৈশিষ্ট্য, একাত্মতা ও অভিন্ন আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয় এবং জাতীয়তাবোধ জাতির জন্ম দেয়। শত শত বছর ধরে অবিরত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে এ ভূখ-ে বসবাসকারী মানুষ পৃথক জনগোষ্ঠী বা জাতি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ জাতি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বা দেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। কখনো সে চেষ্টা সফল হয়েছে। কখনো পরাধীনতার শৃঙ্খল তাকে শৃঙ্খলিত করেছে। পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। কখনো সে সংগ্রাম সফল হয়েছে, কখনো বিফল হয়েছে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার আগে সুবেহ বাংলা স্বাধীন দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। পলাশীর যুদ্ধে এই স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতা হরিত হওয়ার পরদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় কীভাবে হয়েছিল, কেন হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেয়ার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। স্বাধীনতার সুখপাখি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোহার পিঞ্জরে বন্দী হয়। বন্দী সুখপাখিকে মুক্ত করার জন্য এ ভূখ-ের মুসলমানরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। স্বাধীনতার জন্য তাদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল, দেশকে পরশাসন থেকে মুক্ত করা। দ্বিতীয় কারণ, মুসলমান শাসকদের কাছ থেকেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুবেহ বাংলার শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। বিদেশিদের শাসন ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে পুনরায় নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাকে তারা তাদের দায়িত্ব ও লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করে। তখনকার স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মুক্তিযোদ্ধারা পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করে, প্রতিবেশী সম্প্রদায় পরাধীনতাকে মেনে নিয়েছে এবং বিদেশি শাসকদের সহযোগিতা করার নীতি অবলম্বন করেছে। ঐতিহাসিকদের অনেকেই মন্তব্য করেছেন, প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের লোকদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে শামিল না হওয়ার কারণ, এটা ছিল তাদের কাছে প্রভু বদল মাত্র। তারা সম্প্রদায়গতভাবে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেনি। বরং পরাধীনতাকে কবুল করে নব্য শাসকদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে লাভবান হওয়াকেই শ্রেয় জ্ঞান করে । ক্ষমতাহারা মুসলমানদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এদেশের মুসলমানরা একটানা প্রায় একশ বছর ক্ষমতা দখলকারী কোম্পানির সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়। সিপাহি বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে এই সশস্ত্র যুদ্ধ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা- এ নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। শুধু এটুকু জানিয়ে রাখা, এ দেশের মুসলমানরা একদিনের জন্যও পরাধীনতা স্বীকার করে নেয়নি। এ জন্য তাদের অবর্ণনীয় ক্ষতি ও খেসারত দিতে হয়েছে। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার উল্লেখ করেছেন, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ৭৫ বছরের মধ্যে মুসলমানরা ভিস্তিওয়ালার জাতিতে পরিণত হয়, যাদের এক সময় গরিব থাকা ছিল অসম্ভব। জানা যায়, সুবেহ বাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এত অধিক ছিল যে মুসলমান কেন, কোনো জাতি-সম্প্রদায়ের লোকেরই অশিক্ষিত থাকা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। বলা যায়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একশ বছরের শাসনকালের মধ্যে মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে চরম অধঃপতিত সম্প্রদায় বা জাতিতে পরিণত হয়। এ সময় শাসকদের বদান্য, ছত্রছায়া ও পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণিত সব ক্ষেত্রে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের প্রভূত উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয়।
সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা ঢালাওভাবে খুন, অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনার ভয়াবহ শিকারে পরিণত হয়। তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন দশায় পতিত হয়। তারা দিশাহারা, হীনবল ও অসহায় হয়ে পড়ে। বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো শক্তিই আর তাদের থাকে না। সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পরই উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতা সরাসরি ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করে। এই পর্যায়ে এসে উপমহাদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির উদ্ভব ঘটে। দল গড়ে ওঠে। প্রথমে কংগ্রেস, পরবর্তীতে মুসলিম লীগ। কংগ্রেস হিন্দু সম্প্রদায়ের ও মুসলিম লীগ মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করে। দুই সম্প্রদায়ের দাবি-দাওয়া আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে দল দুটি রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করে। এদের যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, আজকের বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, মুসলিম লীগ ঢাকাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা ও অবদান রাখে পূর্ববাংলার মুসলমান সম্প্রদায়।
স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, সুশাসন ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা লাভের প্রেরণা থেকেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর (যা গঠিত হয় মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা) বিমাতাসুলভ আচরণ, শোষণ, বঞ্চনা, গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে এদেশের মানুষ নিশ্চিতভাবেই বুঝে নেয়, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সহজে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রদান না। এ জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। ভাষা আন্দোলন থেকেই এটা বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়। এর পর গণতন্ত্র, সাম্য ও সায়ত্ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অতঃপর আসে স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াই ও যুদ্ধ। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, তার হাতে ক্ষমতা অর্পণে শাসক গোষ্ঠীর টালবাহানা এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা শুরুর প্রেক্ষাপটে শুরু হয় মুক্তির লড়াই, স্বাধীনতার যুদ্ধ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং ৯ মাসের যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হয়, বিজয় অর্জিত হয় এবং বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থান লাভ হয়।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে স্বাধীনতার অঙ্গীকার ও আকাক্সক্ষা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তার মূল্যায়ন প্রাসঙ্গিক। এদেশের মানুষ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুবার স্বাধীনতা লাভ করেছে। প্রথম স্বাধীনতা তাদের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা তাদের কী দিয়েছে, কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে, সে প্রশ্ন তারা করতেই পারে। স্বাধীনতার মূল কথা হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ জনগণের হাতে থাকা। তা কি এখন আছে? যে গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ, তা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? যে অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য ও সুষম উন্নয়ন স্বাধীনতার বিশেষ অঙ্গীকার, তা কি অর্জিত হয়েছে? সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছিল স্বাধীনতার অন্যতম আকাক্সক্ষা, তা কি বাস্তবায়িত হয়েছে? মৌলিক মানবিক অধিকার ও নিরাপত্তা কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? মতামত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীরতা কি নিশ্চিত হয়েছে? বলা বাহুল্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই উত্তর নেতিবাচক। মুক্তিযুদ্ধের সুনির্দিষ্ট তিনটি অঙ্গীকার ছিল। যথা: সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য। এর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে গঠিত রাষ্ট্রটির যে মালিকানা লাভ করেছিল জনগণ, আজ সে মালিকানা তাদের হাতের বাইরে চলে গেছে। জাতীয় ঐক্য এবং ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, সংগ্রাম ও যুদ্ধ স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর ও নিশ্চিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার ফলেই এত কম সময়ে স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আজ সেই জাতীয় ঐক্যে বিশাল ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। বিভেদ, বৈষম্য ও প্রতিহিংসার রাজনীতি জাতিকে সব দিক দিয়ে বিভক্ত করে ফেলেছে। জাতীয় ঐক্য স্বাধীনতা ত্বরান্বিতই করেনি, যুদ্ধের মধ্যদিয়ে তা আরও দৃঢ় ও সুসংবদ্ধ হয়। আজ কোথায় গেলো সেই জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সংঘবদ্ধতা? জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ায় বিপর্যয়ের অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে।
দেশে আজ জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপ্রতিষ্ঠার রাজনীতি অনুপস্থিত। রাজনীতি যে জনসেবা ও জনকল্যাণের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম, সে ধারণা বিলীন। তার স্থলে ক্ষমতা দখল ও ভোগের রাজনীতির জয়জয়কার চলছে। রাজনীতি তার লক্ষ্য পথ থেকে সরে যাওয়ায় জনগণের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ও আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। জনগণ রাজনীতির ব্যাপারে বিমুখ হলে, আস্থাহীন হয়ে পড়লে, বিশ্বাস হারালে তার বিপর্যয়কর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। গণতন্ত্রে ক্ষমতার মালিক জনগণ। আজ ক্ষমতার এই মালিকানা তাদের নেই। ক্ষমতাসীনরা এক নব্য গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছে। গণতন্ত্রে জনগণের রায় ও ভোটের কোনো প্রয়োজন হয় না। বিনা ভোটে বিজয় ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করা যায়। বিগত সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের প্রতিটি স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার নজিরবিহীন সংস্কৃতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ক্ষমতাসীনরা এই নব্য গণতন্ত্রকে আজীবন ক্ষমতায় থাকার উপায় ও অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা তারা শুনতেই পারেন না। তারা বিরোধী দল ও ভিন্নমতের রাজনীতি, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত গণতান্ত্রিক আচার-সংস্কৃতিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছেন না। বিরোধী দল ও ভিন্নমত উৎসাদনের জন্য এমন কোনো পথ নেই যা তারা অনুসরণ করছেন না। রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা, জেল-জুলুম সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধীদলের হাজার হাজার কর্মী জেলে। অনেকে খুন-গুমের শিকার হয়েছেন। আইন-শৃংখলা বাহিনী ও ক্যাডারদের হামলার ভয়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী কেন, সাধারণ মানুষও সদা সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে বাড়ি ছাড়া, ঘর ছাড়া। অসংখ্য মামলার খড়গ তাদের মাথার ওপর ঝুলছে। জননিরাপত্তা বলতে যা বুঝায়, তাও অনেক আগেই উধাও হয়ে গেছে। দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃৃতকারীরা মাথায় উঠেছে। খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ মানুষের জানমালের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই।
অর্থনীতির অবস্থা উদ্বেগজনক। প্রবাসী আয় ও গার্মেন্ট রফতানি আয় থেকে গড়ে উঠা অর্থনীতির ভিত টলটলয়মান। আয় কমছে। ব্যক্তি আয়ও কমছে। দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাত্রার ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। বিনিয়োগ নেই, শিল্পায়নের গতি মন্থর। কর্মসংস্থান নাস্তি। এটা গেল একদিক। অন্যদিকে চলছে নির্বিচার অর্থ লুণ্ঠন ও পাচার। লাখ লাখ কোটি টাকা প্রতি বছর পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। পাচার ও লুটপাটের অর্থ আর ফেরৎ আসছে না। বলা যায়, একটা লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের অভাব, দুঃখ-দুর্ভোগের সীমা নেই। অথচ কিছু মানুষ জাতীয় অর্থ ও সম্পদ বেপরোয়াভাবে লুণ্ঠন করে ঘাড়ে-গর্দানে স্ফীত হচ্ছে। এই বিষম অবস্থা সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে। তা লুটেরারা পরোয়া না করলেও একদিন এই ক্ষোভ-অসন্তোষ বিস্ফোরিত হতে পারে। সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য, সুশাসন কোথাও আর কার্যকর অবস্থাতে নেই। দলীয়করণ, দুর্বৃত্তায়ন সব কিছুর ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
সত্য বটে, স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আমরা একটি ভূখ-, পতাকা ও সঙ্গীত লাভ করেছি। সত্য বটে, স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি হয়েছে। দুই দুইবারের স্বাধীনতা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এত বছরে যতটা উন্নয়ন অগ্রগতি সমৃদ্ধি আমাদের হতে পারতো তা হয়নি। এই ব্যর্থতা রাজনৈতিক দল বিশেষ করে যারা বারবার ক্ষমতায় এসেছে তারা এড়িয়ে যেতে পারে না। এতদিন পরে এসে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার লক্ষ্য অঙ্গীকারগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে। ক্ষমতার জন্য জাতীয় স্বার্থ বেতোয়াক্কা করা হচ্ছে। জনগণের ক্ষমতা অস্বীকার করা হচ্ছে, তাদের চারপাশে পরাধীনতার বেড়া তোলা হচ্ছে, অপ্রাপ্তির হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করা হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, জাতি বিভক্তির সর্বনাশা খেলা জোরদার করে তাদের শক্তি খর্ব করা হচ্ছে। উদ্বেগের আরো একটি বিষয় হলো, একটি বিশেষ দেশমুখী বিদেশনীতি অবলম্বনের মধ্য দিয়ে দেশকে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার তৎপরতা চলছে। চাইবা মাত্র সবকিছু তাকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে অবলীলায়। বিনিময়ে দেশ কিছুই পাচ্ছে না। দেশের রাজনীতিতে ওই দেশটির প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার কথা কারো অজানা নেই। এখন শুধু রাজনীতি নয়, সকল ক্ষেত্রেই তার প্রভাব নিরংকুশ ও বিস্তৃত হচ্ছে। একটি দেশের ওপর এরূপ নির্ভরতা কিংবা তার প্রভাব স্বীকার করে নেয়া দেশের জন্য কতটা মঙ্গল ও কল্যাণকর তা অবশ্যই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়।
বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা অনেকদিন ধরেই বলছেন, দেশ একটা ক্রান্তিকালে পড়েছে। এই ক্রান্তিকাল জনঅধিকার, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও দেশহিতের ওপর হুমকি বিস্তৃত করছে। যে কোনো মূল্যে এই ক্লান্তিকালের অবসান কাম্য। তাদের মতে, এই ক্লান্তিকালের দ্রুত অবসান ঘটতে পারে যদি স্বাধীনতার চেতনা, অঙ্গীকার ও লক্ষ্যসমূহ সামনে এনে সেগুলো বাস্তবায়নে আন্তরিক উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেয়া যায়। এই সঙ্গে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করা যায়। জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হলে এই ক্রান্তিকালের অবসান দ্রুতায়িত হতে পারে। জনগণকে পরাধীনতার মধ্যে রেখে, দমন-পীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার মধ্যে রেখে, নিরাপত্তাহীন রেখে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। দেশের ক্ষমতাসীনরা, রাজনীতিকরা যত দ্রুত এটা বুঝবেন, ততই মঙ্গল। এদেশের জনগণের চরিত্র-লক্ষণ যেভাবে ইতিহাসের পাতায় বিধৃত আছে তাতে আমরা বলতে পারি, তারা জগদ্দল কোনো কিছুই বরদাশত করে না। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, যারা দেশকে স্বাধীন করেছে যুদ্ধের মধ্যদিয়ে বিপুল রক্ত দিয়ে, যারা দেশের প্রকৃত মালিক সেই জনগণ অচিরেই জেগে উঠবে, ঐক্যবদ্ধ হবে এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশকে ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন