বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান, আপত্তি উপেক্ষা করেই অবশেষে ব্যাংক কোম্পানী আইন সংশোধনের বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। বিশেষত: একই পরিবারের চারজন সদস্যকে ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের সদস্য রাখা এবং একাধিক মেয়াদে(একটানা ৯ বছর) সদস্য থাকার সুযোগ সম্পর্কে দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের অনেকের আপত্তি কোন আমলে নেয়া হয়নি। মূলত: সরকারী দলের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মহলের স্বার্থে এবং প্রভাবে এই আইন পাস হয়েছে বলে অভিযোগ তোলার যথেষ্ট কারণ আছে। আইনটির বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টির সদস্যরা সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলেও বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে। নতুন আইন ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে নাকি কিছু পরিবারের স্বার্থ সুরক্ষা করবে এ নিয়েই এখন বিতর্ক চলছে। বিগত বছরটি জুড়েই দেশের ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা ছিল অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আর্থিক খাতে বিগত বছরের চালচিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বেসরকারী গবেষনা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ(সিপিডি) ২০১৭ সালকে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা ও কেলেঙ্কারির বছর হিসেবে অভিহিত করেছে। ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা ও লুটপাটের জন্য যে সব বিষয়কে দায়ী করা হয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও বিচারহীনতা।
দেশের ব্যাংকিং খাত যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরাও বিভিন্ন সময়ে তা স্বীকার করেছেন। জাল-জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে ব্যাংকগুলোকে কার্যত দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের ট্যাক্স থেকে অর্থের যোগান দিয়ে ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বেসিক ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে সরকারী দলের প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা অনেকটাই স্পষ্ট। ব্যাংক জালিয়াতিসহ আর্থিক খাতের বড় কড় কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করতেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিষ্ময়কর অনীহা-অনিচ্ছা দেখা যাচ্ছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রির্জাভ কারেন্সি চুরির ঘটনা নিয়েও এক ধরনের অস্বচ্ছতা ও লুকোচুরি দেখা যাচ্ছে। সিপিডি, টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বিচার বিশ্লেষণ ও সুপারিশ সমুহকেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করে বিরুপ মন্তব্য করছেন। ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দূর করতে হলে প্রথমে এর আইনগত ফাঁক-ফোকড়সহ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। পাশ কাটিয়ে এবং প্রকৃত অবস্থা আড়াল করে কোটারি স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
অর্থমন্ত্রী নিজেই সম্প্রতি সংসদে দেয়া ভাষনে দেশের ‘ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক’ বলে মন্তব্য করেছেন। নাজুক পরিস্থিতির উত্তরণে যে ধরনের আইনী ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি থাকা প্রয়োজন সে দিকে না গিয়ে একটি বিতর্কিত ব্যাংক কোম্পানী আইন পাস করিয়ে নিতে তার আগ্রহ ও মনোযোগ ছিল লক্ষ্যনীয় ও বিষ্ময়কর। বিরোধিদল এবং স্বতন্ত্র সদস্যরা আইনের খসড়াটিকে জনমত যাচাই, পুনরায় বাছাই কমিটিতে পাঠাতে এবং সংসদের আরো আলোচনার জন্য সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করলে অর্থমন্ত্রীর আপত্তির মুখে তাও নাকচ হয়ে যায়। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানী আইনকে ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। আমরা জানি, পাকিস্তান আমলে শিল্প ও আর্থিক খাত মূলত ২২টি পরিবারের মধ্যে কেন্দ্রীভ‚ত হয়ে পড়েছিল। সেই কোটারিভুক্ত অর্থনীতির অর্গল ভেঙ্গে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য। আজ স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পেরিয়ে এসে জাতি দেখছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত কতিপয় পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আইনগত স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক মনিটরিংয়ের অভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো অসৎ, দুর্নীতিবাজ পরিচালকদের হাতে দেউলিয়া হয়ে পড়ার পাশাপাশি প্রায় সব বেসরকারী ব্যাংকেও কালোছায়া পড়েছে। বেসরকারী ব্যাংকগুলো থেকেও ব্যাংক পরিচালকদের পারস্পরিক যোগসাজশে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত এক দশকে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার যে সব তথ্য উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে তার সাথে ব্যাংকিং খাতের সাথে সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ এবং আধিক খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে ধরনের আইনগত ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা দরকার তার কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। উপরন্তু নতুন ব্যাংক কোম্পানী আইনের সুবাদে ব্যাংকগুলোতে প্রভাবশালী মহলের পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা অমূলক নয়। এটা দূর করার দায়িত্ব সরকারের। ব্যাংক আইনের বিতর্কিত বিষয়গুলো পূনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন