ফের হকারদের দখলে চলে গেছে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গুলিস্তান, পল্টন ও মতিঝিলের সড়ক ও ফুটপাত। ফুটপাত দখল মুক্ত রাখার জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করেও তা দখল মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেকবরাই এই দখল প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন হাকার উচ্ছেদের বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকার পরও শেষ পর্যন্ত হকারদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। এক ইঞ্চি জায়গা ছাড় না দিতে মেয়রের হুঁশিয়ারিও টিকল না। গুলিস্তানের ফুটপাত ও সড়ক দখল করে হকারদের বসার সেই চিত্র আবার অনেকটা আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে। মেয়র তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গুলিস্তান, মতিঝিল ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোসহ নিউ মার্কেটের ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করে দিলকুশা, নবাবপুর রোড, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল সংলগ্ন, সেগুনবাগিচা ও বায়তুর মোকাররম মসজিদ এলাকায় পাঁচটি হলিডে মার্কেট চালু করেছেন। এ ছাড়া পুনর্বাসনের লক্ষ্যে হকারদের তালিকা করে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য পরিচয়পত্র প্রবর্তনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, সারা বছর ধরেই আমরা ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের কাজ পরিচালনা করে যাচ্ছি। তবুও সরকারি ফুটপাত ও রাস্তা থেকে তাদেরকে নির্মুল করতে পারছি না। এছাড়া হকার উচ্ছেদের জন্য পুলিশ ফোর্সের প্রয়োজন। বর্তমানে পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স না পাওয়ার কারণে আমরা নিয়মিত হকার উচ্ছেদের কাজ করতে পারছি না। তিনি বলেন, আমরা আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তাদেরকে সকালে উচ্ছেদ করলে, বিকেলে বসে যাচ্ছে। আবার বিকেলে উচ্ছেদ করলে পরদিন সকালে বসে যাচ্ছে। এটা কিভাবে ঠেকানো যায় সেই চেষ্টা করছি এখন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকার উচ্ছেদকৃত ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে যে পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছে, তারাই এখন ফুটপাত দখলের সুযোগ করে দিচ্ছেন। বিনিময়ে তারা হকারদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা নিচ্ছে বলেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এতে ডিএসসিসি মেয়রের ফুটপাত দখলমুক্ত করে পথচারীদের চলাচলে উন্মুক্ত করে দেয়ার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সম্পর্কে অবগত নয় সিটি কর্পোরেশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, স্বেচ্ছাসেবকরা ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে মারও খেয়েছে কয়েক দফায়। তবে দুই-একজন এমন দুষ্ট কেউ যদি থেকে থাকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল, আইডিয়াল স্কুলের সামনে, মৌচাক, মালিবাগ, নিউমার্কেট, ফারমগেট, মিরপুর ও মোহাম্মদ পুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে শীতকালীন কাপড়সহ বিভিন্নস জিনিসপত্রের জমজমাট ব্যবসা করেছে হকারেরা। গুলিস্তান এলাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের প্রবেশ মুখ থেকে বঙ্গবন্ধু স্কোয়ার হয়ে গোলাপশাহ মাজার পর্যন্ত সড়কের দু’ধারে অসংখ্য হকার বসেছে। অনেকে নতুন করে ছাউনী বানাচ্ছেন। গুলিস্তান কমপ্লেক্স থেকে গোলাপশাহ মাজার পর্যন্ত সড়কের অর্ধেক চলে গেছে হকারদের দখলে। সড়কের এ অংশ বন্ধ করে কাপড়, জুতা, ফলসহ নানা পণ্যের বাজার বানানো হয়েছে। পাতাল সড়ক বলে পরিচিত গুলিস্তান আন্ডারপাসের প্রবেশপথ বেলা একটায় বন্ধ দেখা গেছে। এ কারণে সেখান দিয়ে কোনও পথচারী চলাচল করতে পারে না।
আলাপকালে নাসির উদ্দিন নামের এক হকার বলেন, বহু বছর ধরে গুলিস্তানের ফুটপাত-সড়কে ফল বিক্রি করি। এ জন্য প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়। এখানে না বসলে বসবো কোথায়? কাকে চাঁদা দেন জানতে চাইলে তিনি কারও নাম বলতে রাজি হয়নি।
গুলিস্তানের ফুটপাত ও সড়ক দখল হলেও পুলিশকে কিছু বলতে বা তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি। বরং পুলিশ নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য বলেন, এই প্রশ্ন পুলিশকে না করে রাজনৈতিক নেতাদের করুন। গুলিস্তানের ফুটপাতে ব্যবসা করেন মোহাম্মদ মোশারফ বলেন, আমাগো বসার জায়গা দেক, তাইলেই আমরা উইঠ্যা যামু। যতদিন না এইডা দিতে পারবেন ততদিন এইখানেই বমু। এইখানে বই অনেক বছর থেকে, হুট কইরা কইলেই উইঠ্যা যাইতে হইব- উল্টো প্রশ্ন তার।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, সকাল ৯টা থেকে বিকাল পর্যন্ত চারটি গ্রæপে বিভক্ত করে ৯২ জন স্বেচ্ছাসেবক গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও মতিঝিল এলাকায় কাজ করানো হতো। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগের এক অফিস আদেশে ৫২ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পরে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা বাড়িয়ে ৯২ জন করা হয়েছিল। তখন ৯২ জন স্বেচ্ছাসেবক দিয়েও হকারদের সাথে পেরে উঠতো না।
গতকাল সম্পত্তি বিভাগ থেকে জানা গেছে বর্তমানে মাত্র ২৬ জন স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে এই কাজ কারানো হচ্ছে। আগে যে কাজ ৯২ জন দিয়ে করানো সম্ভব হয়নি, বর্তমানে সে কাজ কিভাবে ২৬ জন দিয়ে সম্ভব হচ্ছে জানতে চাইলে সম্পত্তি কর্মবর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমাদের সেচ্ছাসেবকরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার জন্য।
সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট এলাকা ঘুরে অনেক জায়গায় ফুটপাতের হকার ও ডিএসসিসির স্বেচ্ছাসেবকদের খোশগল্পে মেতে থাকতে দেখা যায়। আবার ডিএসসিসির কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসার আগেই এসব স্বেচ্ছাসেকরাই হকারদের খবর দিয়ে সরিয়ে দেন। গতকাল বেলা ১১টা ও দুপুর ২টায় রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও মতিঝিল এলাকায় ফুটপাত দখল করে প্রকাশ্যেই হকারদের ব্যবসা করতে দেখা যায়। এ সময় গুলিস্তান হল মার্কেটের বিপরীত পাশের ফুটপাতে বসেই দুজন পাহারাদারকে হকারদের সাথে খোশগল্প করতে দেখা যায়। গত সপ্তাহ খানেক ধরে পল্টন, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে।
জানা গেছে, লাইনম্যানদের বিরুদ্ধে সিটি কর্পোরেশনের মামলা ও গ্রেপ্তারের পরে তাদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যায়। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর এ সুযোগে ডিএসসিসির স্বেচ্ছাসেবকরা হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবকরা। সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন বলেন, মাঝেমধ্যে হকাররা একটু ছাড় দিতে অনুরোধ করেন। তাদের বউ বাচ্চা আছে। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতে আকুতি জানান তারা। তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের একটু ছাড় দেয়া হয়। এ ছাড়া তারা (স্বেচ্ছাসেবক) সারাক্ষণ ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে কাজ করেন।
প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট এলাকায় পথচারীদের চলাচলের জন্য রাস্তার দুই পাশের ফুটপাত দখল করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ব্যবসায় করে আসছেন হকাররা। সিটি কর্পোরেশন বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবার বেদখল হয়ে যায় এসব ফুটপাত। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদের সময় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। হকার ও লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের হামলার শিকারও হয়েছেন নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। হকারদের বোঝাতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে হকার নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক, মতবিনিময়সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। পুনর্বাসনের জন্য হকারদের তালিকা তৈরি, হলিডে মার্কেট চালু এবং নির্দিষ্ট সময়ে ফুটপাতে হকার বসতে দেয়াসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন