গত ১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। ২০০৯ সালে ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ- চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত পঞ্চম কাউন্সিলে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সাংবাদিক হিসেবে ৭ বছর পর আরো একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। কাউন্সিল পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে মৎস্য ভবনের সামনে রিকশা থেকে নেমে সামনে তাকাতেই যে বিশাল জনসমুদ্র চোখে পড়ে তাতে এটাকে কাউন্সিল না বলে মহাসমাবেশ বললে অত্যুক্তি হয় না মোটেও। আগের রাতে ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত গেইট, মঞ্চ রাতের মধ্যেই কর্মীরা ঠিক করে ফেলে। ভীড় ঠেলে অনেক কষ্ট করে কাউন্সিল মঞ্চের সামনে যতক্ষণে ঢুকলাম, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ততক্ষণে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে জনস্রোত সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক এবং মৎস্যভবন থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তার একপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। কাউন্সিলে কাউন্সিলর ও ডেলিগেইটদের আমন্ত্রণ থাকলেও সারাদেশ থেকে আসা বিএনপির উৎসাহী সাধারণ নেতাকর্মীদের ভীড় সামলানো সম্ভব ছিলো না ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ওই স্বল্প পরিসরে। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র কিম্বা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের মতো স্পেস পেলে বিএনপিকর্মীদের রাস্তায় অবস্থান নিতে হতো না। আমন্ত্রণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নেতাকর্মীদের সমাগম হলেও কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা, খাবার, অন্য কোনো আয়োজনের ঘাটতি চোখে পড়েনি। কাউন্সিল উপলক্ষে ১১টি বই প্রকাশ করেছে বিএনপি। বইগুলো কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিএনপির কাউন্সিলে বেশ কয়েকজন বিদেশী প্রতিনিধি, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকদের একটি দল উপস্থিত ছিলো। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত হতে পারলেও দলটির কেন্দ্রীয় নেতা বিজয় জলি শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠান। বিজেপি নেতার ওই ভিডিও বক্তব্যটি গুরুত্ব দিয়ে পর্দার মাধ্যমে কাউন্সিলে উপস্থিত সবাইকে দেখানো হয়েছে। ভিডিও বার্তা চালু হওয়ার পরপরই বিএনপির নেতাকর্মীরা হাততালি দিয়ে নরেন্দ্র সিং মোদির দল বিজেপিকে অভিনন্দন জানায়। এছাড়া নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এবং কানাডার বিরোধীদলীয় নেতাও শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠান। অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভিডিও বক্তব্য প্রচার করা হয়। মাইকে তারেক রহমানের নাম প্রচারের সাথে সাথে কাউন্সিল জুড়ে পিতপতন নীরবতা নেমে আসে। মাঝে মাঝে নেতাকর্মীরা হাততালি দিলেও পরক্ষণেই নীরব হয়ে শুনেছে তার বক্তৃতা। বিএনপিতে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা এর মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায়।
বিএনপির কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ বক্তব্য। এ বক্তব্যে তিনি বর্তমান সরকারের জুলুম নির্যাতন ও আগামী দিনের পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। এ লক্ষ্যে তিনি বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে প্রণীত ভিশন-২০৩০’র পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এ ভিশনের ব্যাখ্যায় বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য আজো বাস্তবায়িত হয়নি। সেই লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য বাংলাদেশের সকল ধর্ম-বিশ্বাসের মানুষ, পাহাড় ও সমতলসহ সকল অঞ্চলের মানুষ এবং প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের চিন্তা- চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে একটি অংশীদারিত্বমূলক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন, জনকল্যাণমূলক, সহিষ্ণু, শান্তিকামী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা বিএনপির লক্ষ্য। বিএনপি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজনের অবসান ঘটাতে চায়। জাতির সকল অংশ তথা ধর্মীয়, আঞ্চলিক ও নৃ-গোষ্ঠীগত পরিচয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক সুসংহত জাতি গঠন করাই বিএনপির লক্ষ্য। আমরা সকল মত ও পথকে নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালন ও পরিপুষ্ট করতে চাই, যাতে বহু বর্ণেরচ্ছটায় উদ্ভাসিত একটি বাংলাদেশী সমাজ গড়ে উঠবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ‘রেইনবো নেশনে’ পরিণত হবে। ‘রেইনবো নেশন’- প্রবচনটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বর্ণবাদ বিরোধী নেতা আর্চ বিশপ ডেসমন্ড টুটু। রঙধনুর সাত রঙের সুষম সম্মিলনের মতোই জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যেও দেশটির প্রাণে যেন ঐক্যের সুর ধ্বনিত হয় এ প্রত্যাশায় টুটু এ প্রবচন ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে দেশটিতে বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটার পর কালো মানুষের কিংবদন্তী নেতা নেলসন মেন্ডেলা ক্ষমতায় বসার এক মাসের মধ্যেই ‘রেইনবো নেশনের’ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, ‘এই সুন্দর দেশের মাটির সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিকের নিবিড় সম্পর্ক। যেমনটা প্রিটোরিয়ার সঙ্গে জাকারান্ডা গাছের, মিমোসা গাছের সঙ্গে বুশভেল্ডের। রেইনবো নেশন নিজের ও বিশ্বের জন্য শান্তির প্রতীক’। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সৌহার্দ্য ও যুথবদ্ধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘রেইনবো’ নেশন প্রবচনটি খালেদা জিয়া তার ব্যক্তব্যে সার্থকভাবে ব্যক্ত করেছেন।
দেশের এককেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থার অবসান কল্পে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থার অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণœ রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়, প্রান্তিক গোষ্ঠী ও পেশার জ্ঞানীগুণী ও মেধাবী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। আমাদের জাতীয় সংসদকে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে’। বাংলাদেশে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের দাবি প্রথমে জাসদ ও পরে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) করে। এর সাথে তারা ফেডারেল রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করার দাবিও তুলে থাকে। কাজেই দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট বাংলাদেশকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেন। খালেদা জিয়ার বক্তব্যে এ বিষয়টি পরিষ্কার নয়।
সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপি মনে করে, সন্ত্রাসবাদ সকল রাষ্ট্রের জন্যই হুমকির কারণ। এ কারণে বিএনপি বাংলাদেশের ভূ-খ-ের মধ্যে কোনরকম সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে বরদাশত করবে না। বাংলাদেশের মাটি থেকে অপর কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাও মেনে নেবে না। বিএনপি অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অন্য কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সমস্য সৃষ্টি করতে চায় না। একইভাবে বিএনপি আশা করে যে, অন্য কোনো রাষ্ট্রও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে না’। সন্ত্রাস বিষয়ে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করতে কাউন্সিলে বিএনপির তরফ থেকে একটি পুস্তিকাও কাউন্সিলর, সাংবাদিক ও বিদেশী মেহমানদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, “বর্তমান সরকার মুখে জনগণের কথা বললেও সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে জনগণের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। আমরা সংবিধানে শহীদ জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত গণভোটের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবো”। বর্তমান সরকার সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর উপর আস্থা বিশ্বাস’ কথাটিও তুলে দিয়েছে। ক্ষমতায় গেলে সেটি পুনঃপ্রবর্তন করবেন কিনা সে বিষয়ে বক্তব্য থাকলে দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ আশ্বস্ত হতো।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সে রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নেই। আমরা তাদের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে চাই’। সেজন্য তিনি ‘থ্রি জি’ সরকারের ধারণা ব্যক্ত করেন। এ থ্রি জি হলো- গুড পলিসি, গুড গভরনেন্স এবং গুড গভর্নমেন্ট। অর্থাৎ সুনীতি, সুশাসন এবং সু-সরকার। বিএনপি নেতাকর্মীরা চেয়ারপার্সনের বক্তব্যে হাততালি দিয়ে, শ্লোগান দিয়ে সমর্থন জানায়। কার্যত তার এ বক্তব্য দলীয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবীত করেছে।
অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় অধিবেশন ছিলো কাউন্সিলরদের নিয়ে সাংগঠনিক অধিবেশন। সারাদেশ থেকে আসা বিএনপির উপজেলা পর্যন্ত সাংগঠনিক ইউনিটের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে ‘এক নেতা এক পদ’সহ দলের গঠনতন্ত্রের অন্তত ৩০টি সংশোধনী অনুমোদন করেন কাউন্সিলররা। এর মধ্যে সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একজন নেতা একটি পদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কেন্দ্রীয় কোনো নেতা, কোনো অঙ্গদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, একই সঙ্গে জেলা বা মহানগর কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে থাকতে পারবেন না। তবে চেয়ারপারসন বিশেষ বিবেচনায় কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অনুমোদন করতে পারবেন। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে বলা হয়েছে, চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে তিনি তার সমুদয় দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে চেয়ারম্যান হবেন এবং নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ওই পদে বহাল থাকবেন। চেয়ারপার্সনের ক্ষমতা বাড়িয়ে বলা হয়েছে, তিনি স্থায়ী কমিটি ভেঙে দিতে এবং পুনর্গঠন করতে পারবেন। গঠনতন্ত্র সংশোধনের ফলে বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে কর্মকর্তা পর্যায়ে ৫৬টি পদ বেড়েছে। এতে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে সদস্য এখন ৪০৭ জন। চেয়ারপার্সন আরও ১০ শতাংশ সদস্য বাড়াতে পারবেন। নিজের চাহিদামতো যতজন ইচ্ছা ভাইস চেয়ারম্যান পদমর্যাদার উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে পারবেন চেয়ারপার্সন। পাশাপাশি এবার কার্যকর করা হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক ২৫টি উপকমিটি। প্রতিটি উপকমিটিতে থাকবে ১২ জন করে। উপকমিটিগুলো হচ্ছে অর্থ ও পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, গবেষণা, শিল্প ও বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, নারী ও শিশু উন্নয়ন, যুব উন্নয়ন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ, যোগাযোগ ও গণপরিবহন, এনার্জি ও খনিজসম্পদ, মানবাধিকার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মুক্তিযুদ্ধ, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণ, সুশাসন ও জনপ্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জাতীয় সংহতি ও এথনিক মাইনোরিটি। সবমিলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা প্রায় ৮শ জন হবেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। প্রবাদে আছে, অধিক সন্ন্যাসীতে, গাঁজন নষ্ট। এই বিশাল কমিটি বিএনপির জন্য দায় না সম্পদ হবে সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎ দিতে পারে কেবল। বিএনপির কাউন্সিলে ‘আদিবাসী ও সংখ্যালঘু’ বিষয়ক একটি সাব-কমিটি গঠন করা হবে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কাউন্সিলে এ কমিটির নাম পরিবর্তন করে অনুমোদন করা হয়। বিএনপির দলীয় পত্রিকা দিনকালের রিপোর্টে এ কমিটির নাম বলা হয়েছে সংস্কৃতি ও উপজাতি বিষয়ক সাব-কমিটি। কিন্তু অধিকাংশ পত্রিকায় এ কমিটির নাম এসেছে জাতীয় সংহতি ও এথনিক মাইনোরিটি বিষয়ক সাব-কমিটি। বিএনপির গঠনতন্ত্র বাংলায় লেখা। এথনিক মাইনোরিটির বাংলা কি করা হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এ দলের গঠনতন্ত্রে উপজাতি বিষয়ক একটি সম্পাদকীয় পদ রয়েছে। এবারের কাউন্সিলে সংশোধন করে এরসাথে সহ উপজাতি বিষয়ক সম্পাদকের একটি অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
রুদ্ধদ্বার কাউন্সিলে ‘শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচন হবে’ বলে খালেদা জিয়ার বক্তব্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কয়েকজন কাউন্সিলরের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনি মূলতঃ শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসীন ছাড়া নির্বাচন বোঝাতে চেয়েছেন। কাউন্সিলে মহাসচিব ঘোষণা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত কারো নাম ঘোষণা করা হয়নি। মহাসচিব, স্থায়ী কমিটিসহ সম্পূর্ণ কমিটি ঘোষণার দায়িত্ব চেয়ারপার্সনকে দেয়া হয়।
এবারের গঠনতন্ত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী হলো এক নেতার এক পদ। সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা কেউ একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তবে চেয়ারপার্সন বিশেষ বিবেচনায় কাউকে কাউকে রাখতে পারবেন। কাউন্সিল অধিবেশনে তৃণমূল বিএনপির বেশ কিছু নেতা খোলামেলা বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীর খান বলেন, ২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকায় মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি কেন হলো না, তার জবাব চাই। অতীতের আন্দোলনগুলোয় কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে থাকেননি। নেতাদের পাসপোর্ট চেক করা উচিত। ওই সময় কে কোথায় ছিলেন, তার জবাবদিহিতা নেয়া উচিত। নওগাঁ জেলা বিএনপির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, বিগত ৫ জানুয়ারির আন্দোলনের সময় নেতারা কে কোথায় ছিলেন, তা চিহ্নিত করা হোক। আমার জানা মতে, অনেকেই মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন। তাদের ব্যাপারে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে কয়েকজন কাউন্সিলর জেনে-শুনে-বুঝে সময় নিয়ে কমিটি দিতে দলীয় প্রধানের কাছে অনুরোধ জানান। কেউ কেউ দলের সংস্কারপন্থিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তারা বলেন, সংস্কারপন্থিরা বেইমান, কুলাঙ্গার। এদের দলে নেয়া যাবে না। কারণ সুযোগ পেলে তারা আবার বেইমানি করবেন। এর জবাবে খালেদা জিয়া তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘আপনারা তৃণমূলের কমিটি থেকে বেইমানদের বের করে দিন। আমি কমিটি গঠনের সময় মোনাফিকদের রাখব না।’ তিনি বলেন, ‘গতবার ঢাকায় আন্দোলন হয়েছে, আমি স্বীকার করছি। কিন্তু কিছু বেইমান ও মোনাফিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তা বন্ধ করে দেয়, যার কারণে আন্দোলন সফল হয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, দল গঠনের সর্বময় ক্ষমতা পেয়েও বেগম খালেদা জিয়া ‘বেঈমান, মুনাফিকদের’ দল থেকে বের করতে কতোটা সক্ষম হবেন? ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ হতে দেখলে তাকে না শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, ‘সর্বাঙ্গে ব্যাথা ঔষধ দেবো কোথা’? কথা ছিলো তৃণমূলে কাউন্সিলের পর কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে। কিন্তু ‘এক নেতা-এক পদ’ নীতি শোনার পর কৌশলে ইউপি নির্বাচনের অজুহাত তুলে তৃণমূলের কাউন্সিল বন্ধ করে দেন নেতারা। এরপর কিছু কিছু ‘মহাগুরুত্বপূর্ণ’ নেতা তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তারা একাধিক পদে, একই সাথে কেন্দ্র ও জেলার দায়িত্বে না থাকলে কেন্দ্র বা জেলা অচল হয়ে পড়বে। ফলে ‘চেয়ারপার্সনের বিশেষ বিবেচনা’ কথাগুলো সংশোধনীতে যুক্ত হয়। এখন এই বিশেষ বিবেচনার সুযোগ নিতে তার ও তার আশপাশের লোকদের উপর তদ্বিরের চাপ সৃষ্টি হবে। কাউন্সিলে চেয়ারপার্সন ভিশন-২০৩০ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা মূলত বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে তার নির্বাচনী ইশতেহার। কিন্তু সেই ক্ষমতায় কিভাবে যাবে তার কোনো রোড ম্যাপ ছিলো না এ বক্তব্যে। ভিশন-২০৩০-র থেকে এ মুহূর্তে বিএনপির জন্য বেশি প্রয়োজন জাতির উপর চেপে বসা দুঃশাসনের জগদ্দল পাথর অপসারণের রোড ম্যাপ। এবারের কাউন্সিলের প্রতিপাদ্য ছিলো- ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ- গণতন্ত্রে বাংলাদেশ’। কিন্তু কিভাবে দুর্নীতি দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরবে তার কোনো রোড ম্যাপ ছিলো না কাউন্সিলে। খালেদা জিয়া নিজেই বলেছেন, “দেশজুড়ে এখনো সেই ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে। অসংখ্য পরিবার স্বজন হারানো কান্নার রোল এখনো থামেনি। আপনারা অনেকেই দৈহিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু ও চরম নির্যাতিত হয়েছেন। অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বাড়িঘরে ঘুমাতে পারেন না। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। বয়োবৃদ্ধ প্রবীণ নেতা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের তরুণ কর্মী-সমর্থক পর্যন্ত প্রায় সকলেই অসংখ্য মামলায় জর্জরিত। এই চরম দুঃখের দিন কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ্। কারণ, এই জুলুম ও অস্থিরতা বাংলাদেশ বহন করতে অক্ষম”। কিন্তু কীভাবে কেটে যাবে সে বিষয়ে কোনো রূপরেখা তার বক্তব্যে ছিলো না। কাজেই ভিশন-২০৩০-এর সঙ্গে মিশন-২০১৯-ও এখন বিএনপির জন্য প্রয়োজন। পুলিশ ও সরকারী দলের পেটোয়া বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, হুমকির মুখে সারাদেশে বিএনপির হতোদ্যম, আত্মগোপনকারী, নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতাদের সাহস দিয়ে, আশা, ভরসা দিয়ে সক্রিয় করে রাজপথে ফিরিয়ে আনা অনেক বেশি জরুরি। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির দলীয় নেতাকর্মীরা যেন নিজেদের ভোট দিতে পারে, জনগণের ভোট নিতে পারে এবং জনগণের ভোটের সুরক্ষা দিতে পারে সেই মিশন নির্ধারণ করা বিএনপির জন্য অধিক জরুরি। নরেন্দ্র মোদী যখন শেখ হাসিনার সাথে জল ও স্থলের সম্পর্ক অন্তরীক্ষে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছেন, তখন কেন্দ্রের এক নির্বাহী সদস্য বিজয় জুলির ভিডিও বার্তার গুরুত্ব কতোটুকু থাকে তা বুঝতে হবে। এ পরিস্থিতিতে মিশন-২০১৯ ছাড়া ভিশন-২০৩০ অপরিহার্য।
email:palash74@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন