বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

মাদারীপুর স্পিনিং মিল ৬ মাস ধরে বন্ধ ১৫শ’ শ্রমিক অর্ধাহারে-অনাহারে

| প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মাদারীপুর থেকে আবুল হাসান সোহেল : মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে ৩৩ একর জমির উপর জেলার একমাত্র মাদারীপুর স্পিনিং মিল। সরকার ১৩ বছর মিলটি চালানোর পরে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে কিশোরগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর কাছে মিলটি বিক্রি করে দেয়। মিলটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ার পর থেকে ভালোই চলছিল। মাসে ১২শ’ থেকে ১৫শ’ বেল সুতা উৎপাদন হতো মিলটিতে। তিন সিফটে প্রায় এক হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করত। মিলের মালিক সরকারের বকেয়া পরিশোধ এবং ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করার কারণে গত বছরের জুলাই মাসের ১৩ তারিখে সম্পূর্ণ চালু অবস্থায় সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিলগালার মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাদারীপুর স্পিনিং মিল মস্তফাপুর, মাদারীপুর। রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের আর্থিক সহায়তাপুষ্ট একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভ‚মি, স্থাপনা, যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ সমুদয় সম্পত্তি রূপালী ব্যাংক লিমিটেড স্থানীয় কার্যালয় ঢাকা এর নিকট দায়বদ্ধ।
প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত মিলটি চালু না হওয়ায় মিলের প্রায় ১৫শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। মিলের অধিকাংশ শ্রমিক গরিব ও অসহায়। এখন মিল বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শ্রমিকদের দাবি মিলটি যেন দ্রæত চালু হয়।
মিলের এক শ্রমিক মাজেদা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের অনেকেরই স্বামী নাই। এখানকার বেতন দিয়ে সংসার চলত। এখন খুবই দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, তারা যেন দ্রæত মিলটি চালু করে।
মিলের আরেক শ্রমিক মাহিনুর বলেন, প্রায় ছয় মাস ধরে মিলটি বন্ধ হয়ে আছে। আমরা অনাহারে দিন কাটাচ্ছি। নাম না প্রকাশ করার শর্তে মিলের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে অন্যতম মিল হচ্ছে এটি। ব্যক্তি মালিকানায় আসার পর ভালো চলছিল মিলটি। জেলার বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এ মিলে। মস্তফাপুর বাজার ও বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ভ্যান চালক, ইজিবাইক চালকসহ বিভিন্ন মানুষের জীবিকা জড়িত ছিল এই মিলকে ঘিরে। মানুষের কর্মসংস্থান ও এলাকার উন্নয়নের জন্য হলেও মিলটি সরকার বা মালিকানার মাধ্যমে চালু রাখা উচিত। মিলটি বেশি দিন বন্ধ থাকলে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। সরকার যে প্রজ্ঞাপনে মিলটি বন্ধ করে দিয়েছে তাতে পাওনা টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেনি। টাকার কথা বলা ছিল না। তারা অন্যান্য কারণ দেখিয়ে মিলটি বন্ধ করে দেয়।
বিটিএমসির উপ-মহাব্যবস্থাপক কাজী ফিরোজ হোসেন বলেন, মিলটি বন্ধের প্রধান ইস্যু শুধু টাকা নয়, এর সাথে আরো অন্যান্য বিষয় জড়িত আছে। সরকারের সাথে মালিকের যে চুক্তি ছিল তা মালিক পক্ষ রাখেনি। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার মালিক পক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য । কিন্তু মালিক পক্ষ একবারের জন্যও আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি এবং চিঠির কোনো উত্তরও দেয়নি। তা ছাড়াও মালিক ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছে তাও সঠিকভাবে ব্যবহার করেনি। ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করে নাই। সবকিছু মিলে আমরা মিলটি বন্ধ করে দেই এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে আমরা মিলটি বিটিএমসির মাধ্যমে চালানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলাম। এ সময় মালিক পক্ষ হাইকোর্টে একটি রিট করে এ জন্যই মিলটি চালু করতে বিলম্ব হচ্ছে। হাইকোর্ট থেকে রিটের নিষ্পত্তি হলে এবং যদি রায় আমাদের পক্ষে আসে তা হলে আমরা যত দ্রæত সম্ভব মিলটি চালু করে দেবো। কারণ মিলের সাথে বহু লোকের কর্মসংস্থান জড়িত।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক আমরা মাদারীপুর স্পিনিং মিলটি মালিকের কাছ থেকে সরকারের দখলে এনে দেই। মালিক মিলটি চালানোর জন্য সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত দিয়েছিল কিন্তু তিনি সরকারের পাওনা টাকা পরিশোধ করেন নাই দীর্ঘদিন। টাকা পরিশোধের জন্য তার সাথে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে, পত্র দেয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি তাতে কোনো সাড়া দেননি। সর্বশেষ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মিলটি সরকারের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি এই সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আমরা চলমান মিলটি বন্ধ করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি এবং পরবর্তীতে বিটিএমসিকে মিলটির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই।
আমার জানা মতে, সরকার মিলের মালিকের কাছে পাবে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মতো। আর রূপালী ব্যাংক থেকে মালিক ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার মতো। এত টাকা ঋণ নিয়ে সরকারের সামান্য টাকা পরিশোধ করতে পারল না। এতে বোঝা যায়, মালিকের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেটা এখন খতিয়ে দেখতে হবে।
তারপর থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ মিলটি বন্ধ আছে। মিলের শ্রমিকরা তাদের বকেয়া টাকা পাওয়ার জন্য আমাদের কাছে বিভিন্ন সময় এসেছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলেছি। কর্তৃপক্ষ আশ^াস দিয়েছেন তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মিলটি চালু করার ব্যপারে বা অন্য কাউকে দেয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আমরা কিছু জানি না। তবে মিলটি যদি চালু করা যায়, তা হলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে, এলাকার উন্নয়ন হবে। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মিলটি বন্ধ করে দেই এবং সরকারের পক্ষ থেকে যদি মিলটি খুলে দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশ আসে তা হলে পুনরায় মিলটি খুলে দেবো বা মালিক পক্ষকে বুঝিয়ে দেবো। এর বেশি কিছু আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন