শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

ফিস্টুলায় ভাঙছে সংসার ঝরছে প্রাণ

প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বেতাগী (বরগুনা) উপজেলা সংবাদদাতা : বেতাগীতে দারিদ্র্যতা, অপুষ্টি, অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা, অল্প বয়সে বিয়ের কারণে নারীরা প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইতোমেধ্যে উপজেলায় ৪ জন ফিস্টুলা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এই ঘাতক ব্যাধির নিষ্ঠুর নির্মমতার শিকার হয়ে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের জীবন। ভেঙে গেছে সংসার। বাল্যবিয়ে রোধ ও এ বিষয় জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে আগামীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। জানা গেছে, উপজেলার মোকামিয়ার করুনা গ্রামের মুকুল বেগম (৪৫)। একই গ্রামের মো. শাহআলমের সাথে ১৮ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। অদক্ষ দাই দ্ধারা প্রসব করানো ফলে প্রায় ২০ বছর ধরে এ রোগে ভুগছেন। ২ মেয়ে ও ১ ছেলে তার। আক্রান্ত হওয়ার পরথেকে মানুষের কাছাকাছি যেতে পারেন না। সারাক্ষণ ঘরে বসে কাটাতে হয়। জাহানারা বেগম (৪০)। তিনি উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ হোসনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। ১৭ বছর বয়েসে সুলতান হোসেন বেপারির সাথে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ১৯ বছর ধরে এ রোগে ভুগে ধুকে ধুকে চললেও লোকলজ্জার ভয়ে করোও কাছে মুখ খুলেনি। কোথায় বেড়ানো হয় না। ৩ মেয়ে সন্তান তার। জীবনে তার করুণ পরিণতি। স্বামী আরেকটি বিয়ে করে তাকে ফেলে সেই সংসারে অবস্থান করছেন। বর্তমানে কোনমতে তিনি শ্বশুরের আশ্রয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে আছেন। রশিদা বেগম (৩৫)। একই গ্রামের বাসিন্দা আলতাফ হোসেনকে সে বিয়ে করেন ঠিক ১০ বছর আগে। তার ২ ছেলে। এ রোগের কারণে স্বামী আর এখন খোঁজ রাখেন না ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে। তার দুঃখ স্বামী থেকেও নেই এই জগত সংসারে। ছেলেদের কাছেও লজ্জায় কিছু বলতে পারছেন না। সফুরা বেগম (৬০)। যিনি মনে করেন, জীবন যাদের দুঃখে গড়া তার আবার দুঃখ কিশের। ফিস্টুলায় ভুগে আজ সে সর্বস্ব হারিয়েছেন। দেখভাল করার কেউ নেই। বর্তমানে একাকি বসবাস করছেন একটি ঝুপড়ি ঘড়ে। ঠিকানা মোকামিয়া ইউনিয়নের ছোট মোকামিয়া গ্রামে। এদের দিন রাত প্রসাব পায়খানা ঝড়তে থাকে ও প্রসাব পায়খানার বেগ না হওয়ায় সারাক্ষণ দুগন্ধ ছড়াচ্ছে। চিকিৎসকরা জানায়, বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসবের কারণে বাচ্চার মাথা যদি ৩ থেকে ১২ ঘণ্টার অধিক সময় যোনিপথে আটকে থাকে তখন যোনিপথের আশপাশের মাংসপেশী যেমন মূত্রথলি ও কোন কোন সময় পায়ুপথে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই মাংসপেশিতে পচন ধরে এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর সেখানে ছিদ্র হয়। যার ফলে মাসিকের রাস্তা দিয়ে অনবরত প্রসাব-পায়খানা ঝড়তে থাকে এবং এভাবেই একজন নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলার আক্রান্ত হয়। উপজেলা মেডিকেল অফিসার শারমিন আক্তার বলেন, বিলম্বতি ও বাধাগ্রস্থ প্রসব, অদক্ষ দাই দ্ধারা প্রসব করানো, যেখানে জরুরি সেবা নিশ্চিত নয়, সঠিক ও সুষ্ঠু প্রসব পরিকল্পনার অভাব, অল্প বয়সে অধিক সন্তান ও ঘনঘন সন্তান জন্মদান। তাছাড়া দারিদ্র্যতা, অপুষ্টি, অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা, অল্প বয়সে বিবাহের পাশাপাশি সমাজে নারীদের নি¤œ মর্যাদার ফলে এখানে নারীরা প্রসবজনিত ফিস্টুলার শিকার হয়ে আসছে। বাংলাদেশ উইমেন হেলথ কোয়ালিশন (বিডাব্লিউ এইচসি)র বরগুনার ফিল্ড অপারেশন অফিসার বুবলী খাতুন পপী জানান, বিশেষজ্ঞ সার্জন দ্ধারা সঠিকভাবে আপারেশন করলে ৯৫ ভাগ প্রসবজনিত ফিস্টুলা প্রসূতি ভালো হয়ে যায়। সে সব মা নবজীবন লাভ করবে। মল-মূত্র না ঝড়ার কারণে কোন প্রকার দুর্গন্ধ থাকে না, এমনকি সে ভবিষ্যতে আবারও সুস্থ্য, স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসব করতে পারেন। উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সোহরাব হোসেন বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, কিশোরী বয়সে ঘনঘন সন্তান জন্মদান থেকে বিরত রাখা, নিয়মিত প্রসব পূর্ব ও প্রসবপরবর্তী সেবা গ্রহণ, জরুরি প্রসূতি সেবা নিশ্চিত, বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসব রোধ, মিডওয়াইফ দ্ধারা বাড়িতে প্রসব করানো, সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবা গ্রহণ, নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রসবজনিত ফিস্টুলা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে এ রোগে আক্রান্তের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন