আবদুল আউয়াল ঠাকুর
সংবিধান অনুযায়ী জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক হলেও কার্যত সেই মালিকানা এখন আর তাদের হাতে নেই। কেন এবং কী কারণে এই বাস্তবতা সে আলোচনা এখন জাতীয় গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছেছে। গণতন্ত্রের নামে দেশে যে ধরনের দুঃশাসন চলছে তার নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন নেই। যে কেউ অনুভব করছে চলমান অবস্থায় আর যাই হোক গণতান্ত্রিক শাসন অর্থাৎ জনগণের শাসন বলে যে কথা রয়েছে তার কোন অস্তিত্ব বিদ্যমান নেই। গণতন্ত্রে ভোটাধিকারের যে গুরুত্ব এবং তাৎপর্য তা যে সম্পূর্ণ ভূলুণ্ঠিত সে কথা পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনে। সরকার বা নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্টরা যাই বলুন না কেন, জনগণ ঠিকই টের পেয়ে গেছে ভোটের নামে যে ভেল্কিবাজি হচ্ছে তাতে তারা অসহায়, নীরব দর্শক মাত্র। মূলত এই বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে সরকারের অবস্থানগত কারণ থেকেই। এ কথা তো সকলেই স্বীকার করবেন যে, গণতন্ত্রের টিকে থাকা না থাকার বিষয়টি মূলত নির্ভর করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি-নৈতিকতার উপর। পৃথিবীর যেসব দেশে গণতন্ত্রে অবিশ্বাসীরা গণতান্ত্রিকভাবে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন তারাও ক্ষমতায় যাবার পর গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ ভোট ব্যবস্থায় কোন আঘাত করেননি। আবার নির্বাচনে হেরে গিয়েও ভোট নিয়ে কোন অভিযোগ করেননি। এমনকি ভোট ব্যবস্থা তছনছ করতেও কোন ধরনের উদ্যোগ নেননি অথবা সাহস পাননি। অথচ বাংলাদেশে ঘটেছে তার উল্টোটি। ক্ষমতায় যাবার মই নির্বাচনী ব্যবস্থা তছনছ করে দেয়া হয়েছে গণতন্ত্রের পোশাক গায়ে লাগিয়ে-ই। সে কারণে কেবলমাত্র গণতন্ত্রই বিপন্ন তা নয় বরং দেশও বিপর্যয়কর দশায় পড়েছে।
সাংবিধানিকভাবে দেশের মালিক যারা-ই হোক না কেন মূলত জনগণের হয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজনৈতিক দল তথা রাজনৈতিক নেতারা। সুতরাং ভালোমন্দ যা কিছুই ঘটুক তার দায় তাদের উপরই বর্তায়। রাজনৈতিক নেতারাই নির্ধারণ করেন দেশ ও জনগণের ভবিষ্যৎ। চলমান বাস্তবতায় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যেসব বক্তব্য প্রদান করছেন তা বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট যে, তারা গণতন্ত্র বা জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক শাসন নয় বরং নিজেদের শাসন স্থায়ীকরণের লক্ষ্যেই কাজ করছেন। আর সোমতোই সবকিছু পরিচালনা করছেন। সে বিবেচনা থেকেই খারাপ উদাহরণ অনুসরণ করে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে তারা সামনে নিয়ে এসেছেন তথাকথিত উন্নয়নের সেøাগান। এটি নতুন কিছু নয়। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, জনগণের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া সব শাসকই এক সময়ে তথাকথিত উন্নয়নের কথা বলেন। এ থেকে মনে হতে পারে, উন্নয়ন আর গণতন্ত্র বুঝি পরস্পর বিরোধী। আসলে তা নয়। উন্নয়ন আর জনগণের অংশগ্রহণ তো পরস্পরের সাথে মিলেমিশে রয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেও এ কথা প্রমাণিত যে, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের বর্তমান হালচাল দেখলেও একথা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, গোটা দেশ এক ধরনের আস্থার সংকটে রয়েছে। এর মূল কারণ জনগণের অংশগ্রহণের অনিশ্চয়তা। এটাও প্রমাণিত যে জনগণের মধ্যে ভিত্তি না থাকলে দৃষ্টি ঘোরাতে নানা ইস্যুর নাম ভাঙ্গানো হয়। এর হাজার হাজার নজির রয়েছে। খুব কাছের দেশ মিয়ানমার। একটু ফিরে দেখলে দেখা যাবে, সেখানকার স্বৈরশাসকরা নিজেদের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে মাত্র সেদিনও সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের জিম্মি করেছিল। ধর্মীয় বিশ্লেষণে যে বৌদ্ধ ধর্মকে অহিংস বলে বলা হয় সেই ধর্মাবলম্বী কোন কোন ভিক্ষু এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে বিশ্ব বিবেককে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সহিংস বর্বরতা-অমানবিকতা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, ইতিহাসের অনেক আলোচিত-সমালোচিত নির্মমতাও হার মেনেছিল। মিয়ানমারে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন সেখানে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সর্বপ্রথম একজন বেসরকারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন যিনি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এখন মিয়ানমারকে নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। আন্তর্জাতিক মহলের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, রাজনীতিকদের বিচক্ষণতা এবং সর্বোপরি সেখানকার জনগণের গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা থাকার কারণেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের শাসনে প্রত্যাবর্তনের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রবাক ওবামা বলেছেন, কিউবা পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। দুনিয়া জোড়া যখন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রবণতা সক্রিয় হয়ে উঠেছে তখন বাংলদেশে বইছে ভিন্ন বাতাস। সাধারণভাবে মনে করা হয়, আগে থেকে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলে রোগের আক্রমণ দূর করা সহজ। আক্রান্ত হয়ে গেলে ওষুধ ছাড়া বিকল্প নেই। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যে উদ্যোগ আয়োজন করা হয়েছিল তাতে কাজ হয়নি বরং উল্টো ফল দিয়েছে। তাই গণতন্ত্রের রোগ সারাতেই বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দলের ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে ঘোষণা করেছেন ভিশন -২০৩০।
দেশি-বিদেশি বিশিষ্টজন, মেহমান, রাজনীতিকদের উপস্থিতিতে বিপুল জনসমাগমে বিএনপির যষ্ঠ কাউন্সিলে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সমৃদ্ধ দেশ ও আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ‘ভিশন-২০৩০’-এর রূপরেখা দিয়েছেন। জাতীয় সমঝোতার ইতিবাচক ও ভবিষ্যতমুখী রাজনীতির আহ্বান জানিয়ে বেগম জিয়া বলেছেন, তার দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে এবং দুই কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। একই সাথে তিনি প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যতমুখী এক ধারার সরকার ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে আবারো তিনি সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। তিনি বলেছেন, দেশের প্রায় সবাই একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার চায়। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, জেগে উঠুন, ঐক্যবদ্ধ হোন, আপনাদের যে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে তা ছিনিয়ে নিন, এত জুলুম ও অস্থিরতা বাংলাদেশ বহন করতে অক্ষম। অন্ধকারের পর্দা দুলে উঠেছে। অচিরেই আলো আসবে। বেগম জিয়া বলেছেন, মহান মুািক্তযুদ্ধের অঙ্গীকার সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য আজো বাস্তবায়িত হয়নি। সেই লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য বাংলাদেশের সকল ধর্ম-বিশ্বাসের মানুষ, পাহাড় ও সমতলসহ সকল অঞ্চলের মানুষ এবং প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে একটি সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা বিএনপির লক্ষ্য। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করা হবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য অলাদা টিভি চ্যানেল খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। তথ্য ও যোগাযোগ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে উল্লেখ করে বেগম জিয়া বলেছেন, মেয়েদের স্নাতক ও ছেলেদের জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে। ভিশন-২০৩০ রূপরেখায় মানবাধিকার, সুনীতি, সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দূর করার অঙ্গীকার করেছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন। বিএনপি তথা বেগম জিয়ার এই ঘোষণা ইতোমধ্যেই সকল মহলে আলোড়ন তুলেছে। আলোচনা-সমালোচনাও হচ্ছে নানাভাবে। এটিই সঙ্গত ও স্বাভাবিক। সে বিবেচনায় বলা যায়, বিএনপির আলোচ্য সম্মেলন দেশের সাধারণ ও সকল শ্রেণীর মানুষকে খানিকটা যে নাড়া দিতে পেরেছে সেটাই বড় সাফল্য বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বস্তুত যে রূপরেখা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য যে সংস্কার প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন তাকে এক কথায় বলা যায়, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস বা দলীয় আনুগত্য নয়, মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, সততাও সৃজনশীলতাকেই সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। সময়কে বিশ্লেষণ করে সঙ্কটকে সুনির্দিষ্ট করে তিনি সুনির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছানোর ফর্মুলা দিয়েছেন এবং সকলকে তা অনুসরণের আহবান জানিয়েছেন।
একথা সকলেই স্বীকার করবেন যে, ‘৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও লক্ষ্য কেবলমাত্র পতাকা বদল ছিল না। বরং স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে এমন একটি উদার গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জাতি দেখেছিল যেখানে থাকবে সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য। বাস্তবে কি হয়েছে এবং হচ্ছে বোধকরি তার বিশদ আলোচনা অর্থহীন। সরলিকরণ করলে বলা যাবে, একদিকে গণতন্ত্রের লেবাসে ফ্যাসিবাদ অন্যদিকে অর্থনৈতিকসহ সামাজিক বৈষম্য এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরও কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর দিয়েই বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবসান সম্পন্ন হয়েছিল। ৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার বিল্পবের মধ্যদিয়ে সেই অচলায়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের সূত্র ধরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলে তিনি পুনরায় বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রবর্তন করেছিলেন। সে ধারা মোটমুটি চলছিল। একদল বিপদগামী সেনা সদস্যের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদতের পর কিছুদিন যেতে না যেতেই নেমে আসে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে প্রথম সামরিক শাসন। গণতন্ত্র পুনরায় অবরুদ্ধ হয়। নতুন গণতান্ত্রিক লড়াই শুরু হয়। ৮২ থেকে ৯০ প্রায় ১০ বছর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিল দেশের রাজনীতিকরা। আর এটাকে স্থায়ী রূপ দিতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। রাজনীতির মাঠে জনতার ম্যান্ডেট হিসেবে এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন আর তা বহাল নেই। এই না থাকা হয়তো খুব বড় আকারে বিবেচিত হতো না যদি জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ধারা অবারিত রাখা যেত। বাস্তবে যে সেটি নেই সেকথা এখন আর লিখে বলে বুঝাবার কোন প্রয়োজন নেই। দেশের নাবালকরাও নির্বিচারে ভোট দিচ্ছে অথচ- ‘আমার ভোট আমি দেব’ এ বাস্তবতা তিরোহিত হয়েছে বা হওয়ার পথে রয়েছে। সে বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যই আজ ভূলুণ্ঠিত। ২০১৪ সালে অগ্রণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের যে অধিকার হারিয়ে গেছে তার পুনরুদ্ধারে লড়াই প্রকৃত বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নেরই লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা এড়িয়ে অন্য যাকিছুই করা হোক না কেন তাকে কোন বিবেচনাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন বলা যাবে না। সেই বিবেচনায় জনগণের ভোটাধিকার অর্জনে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠার ভিশন হিসেবে বিবেচনা করা যায় ভিশন-২০৩০ কে। এখানেই শেষ নয়। বেগম জিয়া ক্ষমতায় ভারসাম্য আনায়নের নিমিত্তে যে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছেন তাও কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকেই। অবশ্যই ভাববার রয়েছে কেন এবং কী কারণে দেশ আজ গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরশাসনে কবলে পড়েছে। একজন সৎ দক্ষ যোগ্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমান জনগণের অন্তরের ভালোবাসা পেয়েছিলেন তিনি এখনো জনগণের মণিকোঠায় স্থায়ী আসনে রয়েছেন। পরবর্তীতে এ অবস্থা টিকে থাকেনি। ’৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর গঠিত সংসদে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃ প্রবর্তন করে হয়তো মনে করা হয়েছিল এটাই জনগণের শাসন নিশ্চিত করার সর্বোত্তম পদ্ধতি। ১/১১-এরপর দেখা গেল, এটাও ঠিক নেই। প্রকৃতপক্ষে কোনটি টিকবে বা টিকতে পারে সে নিয়ে অবশ্য বাংলদেশের প্রেক্ষিতে মতামত দেয়ায় মারাত্মক জটিলতা রয়েছে। দেশে জনগণের শাসন নিশ্চিতকরণে সকল রাজনীতিক একমত না হলে বা মানসিকভাবে মতৈক্য না থাকলে জনগণের শাসন টেকে না। এব্যাপরে বিএনপি এবং বেগম জিয়ার যে ধরনের দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে এবং তিনি ও দলটি যেভাবে তার স্বাক্ষর রেখেছে সে উদাহরণ সকলের বেলাতে রয়েছে তা বলা যাবে না। সে কারণেই ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য কঠিন তবে আপাতদৃষ্টিতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ভিশন-২০৩০-এ ভারসাম্যের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অনেকটাই প্রত্যাশা পূরণের কাছাকাছি অবস্থান করছে। কারণ সকলে মিলে ভুল করলেও তা শোধরানো সহজ। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়াই মূল বিষয়। বেগম জিয়া তিনতিনবার ক্ষমতায় ছিলেন। বিএনপি দীর্ঘদিন জনগণের সমর্থনে দেশ শাসন করেছে। দেশে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে এমনটা কখনো হয়নি। বলা যায় দুঃশাসন-দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান অনেকটাই জরুরি। সে বিবেচনায় গুড পলিসি, গুড গভর্নেন্স, গুড গভর্নমেন্ট ইতিবাচক ধারণা।
বিএনপির ৬ষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে নানা বিশ্লেষণ থাকতে পারে। এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। জনগণের শাসনের কথাই বলা হোক আর ভালো সরকার ব্যবস্থার কথাই বলা হোক সবকিছুর চেয়ে বড় হচ্ছে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে সরকারের ইচ্ছায় প্রতিবেশী দেশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হস্তক্ষেপের ফলে যে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার সমাধান না হলে অনেক বড় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার বক্তব্যকে গভীরভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। বিএনপি অন্য রাষ্ট্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে চায় না জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে বিএনপি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অন্যকোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অন্য কোন রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে চায় না। একইভাবে বিএনপি আশা করে অন্যকোন রাষ্ট্রও বাংলদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং বাংলদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে না। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্বার্থের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবে। স্বাধীনতার মাস ঐতিহাসিক মার্চের এমন এক সময়ে বেগম জিয়া এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিলেন যার সাথে হয়তো কেবলমাত্র তুলনা করা চলে ’৭১-এর মার্চ মাসের। যখন জাতি এক মহা সঙ্কটে নিপতিত ছিল তখন একজন মেজর জিয়ার কণ্ঠ থেকে জাতি শুনেছিল স্বাধীনতা তথা মুক্তির আহবান। জাতি হিসেবে বাংলাদেশিরা কোথায় যেন ‘বান্ধা’ পড়ে গেছে সেই বন্ধন মুক্তির গানই বেগম জিয়া শুনিয়েছেন জাতীয় কাউন্সিলে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া রজনৈতিক দল বিএনপি। দলটি শুরু থেকেই বহুদলীয় গণতন্ত্র, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী হিসেবে বেড়ে উঠেছে। দেশের জনগণের বৃহত্তম অংশের প্রতিনিধিত্বকারী এই দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশে গণতন্ত্র রক্ষায় আপোষহীন ভূমিকা রেখে আসছে। ৮১ সালে কতিপয় বিভ্রান্ত সেনা সদস্যের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদতবরণ করার পর থেকে দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি জনগণের পক্ষ ত্যাগ করেননি। সবকিছু সত্ত্বেও এটা বলা যায়, গত কয়েকবছর ধরে বিএনপি তথা মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদীদের উপর যে নির্যাতন-জুলুম যাচ্ছে সে প্রেক্ষিতে একটি জাতীয় সম্মেলন করতে পারাটা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও পরিপক্বতারই পরিচায়ক। সময়ের বিবেচনায় এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভিশনের ঘোষণা নয়, লক্ষ্য অর্জনে সকলে আন্তরিক হবে, এটাই সময়ের দাবি।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন